আমেথির আশীর্বাদ প্রিয়াঙ্কা

প্রিয়াঙ্কা গান্ধী
প্রিয়াঙ্কা গান্ধী
>

• কংগ্রেসের হালচাল
• রাহুল গান্ধীর নির্বাচনী আসন উত্তর প্রদেশের আমেথি
• এই আসন থেকেই প্রচারণা শুরু করেছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী

ভাগ্যিস, সর্বভারতীয় কংগ্রেসের উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর মধ্যে বিন্দুমাত্র ছুঁৎমার্গিতা নেই। থাকলে আবালবৃদ্ধবনিতা এভাবে তাঁর কাছে হামলে পড়তে পারত না।

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর নির্বাচনী আসন উত্তর প্রদেশের আমেথি। এখান থেকেই শুরু হয়েছে প্রিয়াঙ্কার রোড শো। গাড়ির ছাদে গ্যাঁট হয়ে বসে রয়েছেন তিনি সবুজ শাড়ি পরে। তাঁকে আগলে বসে–দাঁড়িয়ে স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপের কমান্ডোরা। এঁরা হাসেন না। মুখে বিরক্তি প্রকাশ করেন না। নিকষ কালো চশমায় চোখ ঢেকে থাকেন। মানুষ হয়েও এঁরা যেন রোবট। কিন্তু প্রিয়াঙ্কার কাছে কীভাবে এঁরা যেন বারবার হেরে যান। কেমন যেন বাধ্য হয়ে পড়েন। দশ হাত দূর থেকে দেখছি, ভিড় ঠেলে প্রিয়াঙ্কার গাড়িবহর গুটি গুটি এগোচ্ছে। প্রিয়াঙ্কার আগ্রহে কমান্ডোরা ভিড় থেকে একের পর একটা শরীর টেনে তুলছেন। কেউ গালে গাল ঠেকিয়ে সেলফি তুলছে। কেউ সই নিচ্ছে। কারওবা আশীর্বাদী হাত উঠছে প্রিয়াঙ্কার মাথায়। এক মহিলা স্নেহভরে গাল টিপে প্রিয়াঙ্কাকে আদরও করলেন। বিরক্তি তো কোন ছার, প্রিয়াঙ্কার মুখে দাদি ইন্দিরার সেই ভুবনমোহিনী হাসির অবিকল জলছবি!

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ব্যারিস্টার ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রয়াত অজিত পাঁজার কথা মনে পড়ে গেল। কংগ্রেস ছেড়ে তখন সদ্য তিনি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। একদিন কথায় কথায় বললেন, ‘হাসতে জানলে সাত খুন মাফ হয়ে যায় রে। হাসতে জানতেন উত্তমকুমার। আর, হাসি ছিল ইন্দিরা গান্ধীর। মায়ের সেই মনভোলানো হাসি পেয়েছিলেন রাজীব। উত্তরাধিকারসূত্রে সেই হাসির মালকিন এখন প্রিয়াঙ্কা। ও–ই ভবিষ্যৎ কংগ্রেসের সম্পদ।’

প্রিয়াঙ্কা কিন্তু এবার দাঁড়াব দাঁড়াব করেও ভোটে দাঁড়ালেন না। তবে দলে এসেছেন আনুষ্ঠানিকভাবে। আজ না হোক কাল ঠিক দাঁড়াবেন। এ নিয়ে কংগ্রেসের কর্মী–সমর্থকদের মনে আজ আর কোনো সন্দেহ নেই। তবে কারও কারও মনে সন্দেহ রয়েছে রাহুল গান্ধীকে নিয়ে। আমেথির পরীক্ষায় তিনি পাস করবেন তো?

সন্দেহটা মাথাচাড়া দিয়েছে টিম মোদির সদস্য স্মৃতি ইরানির কারণে। গত লোকসভা নির্বাচনে রাহুলের জয়ের মার্জিন ১ লাখ ৭ হাজারে নামিয়ে এনেছিলেন তিনি। এবার সেটাই বিজ্ঞাপন করে তিনি কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। এমন এক হাওয়া ভাসিয়েছেন যে রাহুলকে এবার তিনি ধরাশায়ী করেই ছাড়বেন। মাসখানেক হলো, আমেথিকেই ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছেন স্মৃতি। চষে ফেলছেন একটার পর একটা গ্রাম। পুঁজি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নাম, তাঁর দেওয়া শৌচালয়, রান্নার গ্যাস, চাষির নষ্ট হওয়া ফসল বাবদ তিন খেপে মোট ছয় হাজার টাকা এবং শক্তিশালী ভারত গড়ার প্রতিশ্রুতি। আর পুঁজি রাহুলের দ্বিতীয় কেন্দ্র হিসেবে কেরালার ওয়েনাডকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত। ভাষণে বলছেন, ‘বুঝতে পারছেন না, আমেথির পাশাপাশি ওয়েনাডেও কেন ভোটে দাঁড়ালেন রাহুল? এখানে ধরা পড়ে যাবেন বলে। বছরের পর বছর জিতছেন, অথচ আমেথির উন্নতির নাম নেই।’

এই সন্দেহটাই যেন গত সোমবার প্রকাশ হয়ে পড়ল। প্রিয়াঙ্কাকে সরাসরি শুনতে হয়েছিল প্রশ্নটা, ‘রাহুল কি ভয় পেয়ে ওয়েনাডকে বেছে নিলেন? আমেথিকে কি তিনি আর নিরাপদ ভাবছেন না?’

প্রিয়াঙ্কা ঘাবড়াননি মোটেই। বিরক্তও হননি। বরং প্রশ্নকর্তার দিকে চেয়ে অবিশ্বাসের সুরে ‘ঠাট্টা করছেন নাকি?’ মন্তব্য করে বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবে, ‘মোটেই না। নিরাপদ না ভাবার কারণই নেই। দক্ষিণ থেকে প্রস্তাবটা এসেছিল। আমেথির জেলা কমিটি পর্যন্ত রাহুলকে উৎসাহিত করেছে ওয়েনাড থেকে দাঁড়াতে। আমরাও সবাই খুশি। কারণ, রাহুল উত্তর ও দক্ষিণ—দুই অঞ্চলেরই প্রতিনিধিত্ব করবেন।’

আমেথির গ্রাম ও শহর ঘুরে বোঝা গেল, এত বছর ধরে যাঁরা গান্ধী পরিবারকে তাঁদের কাছের বলে ভেবে এসেছেন, ওয়েনাড নিয়ে তাঁরা আদৌ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নন। দুশ্চিন্তাটা অবশ্য কাটিয়েছেন কংগ্রেসের নেতারাই। কীভাবে, তা বলার আগে বরং স্থানীয় এক চিকিৎসকের অভিজ্ঞতার কথা শোনা যাক। একবার তিনি মুম্বাইয়ে গেছেন। ফেরার টিকিটের খুব হাহাকার। অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর পর কাউন্টারে এসে যখন বললেন, আমেথি ফেরার একটা বন্দোবস্ত করে দিতেই হবে। তিনি বলেন, ‘কাউন্টারের ওপাশের মুখটা আমেথি শুনে কীভাবে কে জানে, একটা টিকিটের ব্যবস্থা ঠিক করে দিলেন! গান্ধী পরিবারই গোটা দেশের সঙ্গে আমেথির পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমরাও পরিচিতি পেয়েছি। এটা কি কম পাওনা?’

এই চিকিৎসক, হাটে সবজি নিয়ে আসা ব্যাপারী, মাঠে গম কাটতে থাকা চাষি কিংবা অপরিসর আমেথি শহরের দোকানি—রাহুলের জয় নিয়ে কারও মনে সংশয় নেই। তেজারতির কারবারি কুন্দনের কথায়, ‘মোদি আবার সরকার গড়বেন। কিন্তু তাঁর স্নেহধন্যা স্মৃতি ইরানীর এবারও জেতা হবে না।’ খানিক থেমে আবার বললেন, ‘খুব যে খুশি তা বলব না। এই তল্লাটের আরও অনেক উন্নতি হতে পারত। কিন্তু এটাও ঠিক, আমেথি ও রায়বেরিলিকে পরিচিতি দিয়েছেন রাহুল–সোনিয়ারাই। ওঁদের হারানো নামুমকিন হ্যায়।’

নামুমকিন মানে অসম্ভব। এই অসম্ভবের একটা কারণ যদি হয় এই দুই কেন্দ্রের সঙ্গে গান্ধী পরিবারের দীর্ঘ চল্লিশ বছরের সম্পর্ক, অন্য কারণটা হলো কংগ্রেস শিবির থেকে ছড়িয়ে দেওয়া এক সংকেত। রাহুলের জয় নিয়ে স্মৃতি ইরানীর যাবতীয় প্রচার, এই যেমন, মোদি ক্ষমতায় থাকলে গান্ধীরা জেলে যাবেন, গান্ধীরা জেলে থাকলে আমেথি–রায়বেরিলি অনাথ হয়ে যাবে, বিকাশ এই দুই কেন্দ্র থেকে বেপাত্তা হয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি একটু হলেও দুশ্চিন্তার জাল ছড়িয়েছিল। এর পাশে রাহুলের ‘ওয়েনাড সিদ্ধান্ত’ হয়ে ওঠে বাড়তি হাতিয়ার। সন্দেহ ও সংশয়ের সেই বীজ অঙ্কুরে টিপে মারতে কংগ্রেস নেতারা দাবি করেছেন, দুটো কেন্দ্র থেকে জেতার পর রাহুল আমেথি ছেড়ে দেবেন। তুলে দেবেন প্রিয়াঙ্কার হাতে। সম্পর্কের গাঁটছড়া যাতে অটুট থাকে।

আমেথি ও রায়বেরিলি যদি দিঘি হয়, গান্ধীরা তাহলে মাছ। সেই গান্ধী পরিবারের নবতম সংযোজন প্রিয়াঙ্কা। আমেথি–রায়বেরিলি তো বটেই, গোটা দেশের কংগ্রেসি মহলে প্রিয়াঙ্কাই এখন বসন্তের বাতাস। আমেথি ও রায়বেরিলির আশীর্বাদ।