শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে সব দেশের প্রতি আহ্বান জাতিসংঘের। শিগগিরই সরকার গঠন করবে তালেবান।
রাজধানী কাবুলে তালেবান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরদিনই দেশ ছাড়তে ভীতসন্ত্রস্ত হাজারো মানুষ জড়ো হয় বিমানবন্দরে। বিমানবন্দরে উড়োজাহাজে ওঠার মরিয়া চেষ্টায় সৃষ্ট বিশৃঙ্খলায় অন্তত পাঁচজন নিহত হন। পাকিস্তান সীমান্তেও ছিল মানুষের ঢল।
আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখল নিয়ে উৎকণ্ঠা ছড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে। দুই দশক পর প্রায় রক্তপাতহীনভাবে তালেবানের কাবুল দখল বিশ্বরাজনীতিতেও বিস্ময় তৈরি করেছে। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে তালেবান শাসনের রূপরেখা কেমন হবে, তা নিয়ে আলোচনা। কাবুল দখলের আগে থেকেই কাতারের রাজধানী দোহায় এ নিয়ে আলোচনা চলছে।
তালেবান মুখপাত্র মোহাম্মদ নাঈম গতকাল আল-জাজিরাকে বলেছেন, আফগানিস্তানের নতুন সরকার কেমন হবে, তা শিগগিরই প্রকাশ করা হবে। তালেবান বিচ্ছিন্ন থাকতে চায় না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলে এগোতে চান তাঁরা।
এবার তালেবানের ক্ষমতা দখল নিয়ে বিশ্বনেতৃত্ব আগের মতো জোরালো প্রশ্ন তুলবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। গতকালই যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার শর্ত মানলে ওয়াশিংটন তালেবানকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া তালেবানের ওপর আস্থা রাখার আভাস দিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও আফগানিস্তানে সব পক্ষের অংশগ্রহণে মতৈক্যের সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছে।
গত রোববার কাবুল ও প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেস দখলের দিনই তালেবান নেতারা বলেছেন, কয়েক দিনের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর চান তাঁরা।
এদিকে গতকাল রাতে কাবুল বিমানবন্দর ঘিরে ফেলে ফাঁকা গুলি ছোড়েন তালেবান যোদ্ধারা। দেশ ছাড়তে বিমানবন্দরে জড়ো হওয়া লোকজন এ সময় আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকে। অনেকে পালানোর চেষ্টা করে। আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলার কারণে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পর তালেবান বাহিনী একের পর এক শহর দখল করতে থাকে। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানের নামে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী এই তালেবানকেই ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে।
বিমানে উঠতে হুড়োহুড়ি
আফগানিস্তান থেকে নাগরিক ও কর্মীদের উদ্ধারে ছয় হাজার সেনা পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির সেনারা কাবুল বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। সেখান থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অন্যান্য দেশ ও দাতা সংস্থাগুলো তাদের কর্মীদের সেখান থেকে ফিরিয়ে নিচ্ছে।
এদিকে কাবুল থেকে বাণিজ্যিক ফ্লাইট বন্ধ হওয়ায় অনেক বিদেশি ও আফগান নাগরিকেরা সেখানে আটকা পড়েছে। উড়োজাহাজে উঠতে আফগানদের প্রাণপণ চেষ্টার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যায়, বিমানবন্দরের টারমাকে দাঁড়িয়ে থাকা একটি উড়োজাহাজে উঠতে চেষ্টা করছে শত শত আফগান। উড়োজাহাজে ওঠার সিঁড়িতে চলছে হুড়োহুড়ি। কে আগে উঠবে, তা নিয়ে ধাক্কাধাক্কি। অনেকে আবার সিঁড়ির রেলিংয়ে ঝুলেই পৌঁছানোর চেষ্টা করে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি উড়োজাহাজ উড়াল দিলে মানুষ নিচে পড়ছে। এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে রাখসান্দা জালিলি নামের একজন মানবাধিকারকর্মী বিবিসিকে বলেন, ‘তারা (আমেরিকান) কীভাবে আমাদের বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং আফগানদের ওপর শর্ত জুড়ে দেয়? এটা আমাদের বিমানবন্দর। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কূটনীতিকদের উদ্ধার করা হচ্ছে আর আমরা সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তা নিয়ে অপেক্ষা করছি।’
গুলি–লুটপাট–আতঙ্ক
সোমবার সকালে কাবুলে অনেক বাড়িতে লুটপাট এবং বিচ্ছিন্নভাবে গোলাগুলি হয়েছে বলে বিবিসির খবরে বলা হয়েছে। আয়শা খুররাম নামের কাবুলের এক শিক্ষার্থী টুইটে লিখেছেন, গুলি ও চিৎকার–চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেঙেছে তাঁর। কিছু মানুষ বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে। এসব বাড়িতে থাকা গাড়ি ও বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। তবে তালেবান যখন এলাকায় যাচ্ছে, তখন তারা পালাচ্ছে।
কাবুলের পরিস্থিতি বর্ণনা করে আফগানিস্তানের সাবেক এমপি ফারজানা কোচাই বলেন, লোকজন আতঙ্কিত। তারা এমন একটি পরিস্থিতিতে পড়েছে, যা ধারণায় ছিল না, যা ঘটছে তা বিশ্বাস করতে পারছে না—কোথায় যাবে, কী করবে। তাদের সবার মধ্যে ভয়, যেকোনো সময় মারা যেতে পারে।’
পাকিস্তানের দৈনিক ডন জানিয়েছে, সোমবার কাবুলের প্রধান মোড়গুলোতে তালেবান যোদ্ধারা অবস্থান নেন। লোকজনও ঘরের মধ্যেই ছিল। স্বাভাবিকের তুলনায় সড়কে গাড়ি ছিল কম। শহরে তালেবান যোদ্ধাদের গাড়িতে তল্লাশি চালাতে দেখা যায়। এর মধ্যেই বিভিন্ন বাড়ির ফটক ও দরজায় অস্ত্রধারীদের হানা এবং লুটতরাজের খবর আসে।
কাবুলের মিডিয়া কোম্পানি মোবি গ্রুপের পরিচালক সাদ মোহসেনি টুইটারে লিখেছেন, তালেবান যোদ্ধারা তাঁর কোম্পানিতে এসেছিলেন। নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে থাকা অস্ত্র সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন। তালেবানের একজন মুখপাত্র জানান, তাঁদের যোদ্ধারা শহরের বেসামরিক নাগরিকদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে নিচ্ছেন।
আতঙ্ক এখন আফগানিস্তানজুড়ে। তালেবানের দখলে যাওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ শহর মাজার–ই–শরিফের অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। লোকজন পারতপক্ষে ঘর থেকে বেরোচ্ছে না। নাসিম জাভিদ নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, প্রিয় দেশকে চিনতেই তাঁর কষ্ট হচ্ছে। অজানা এক আতঙ্ক ভর করেছে। জাভিদ বলেন, আফগানিস্তানের সবচেয়ে উদার শহরগুলোর একটি মাজার–ই–শরিফ। শিশুরা এখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি গান শেখা ও সিনেমা দেখার মতো বিনোদন নিয়ে বড় হয়। এখন তা আর সম্ভব হবে না বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নাসিম জাভিদের মতো অনেক আফগানের আশঙ্কা, তালেবান আবার দেশে শরিয়া আইন চালু করে তা মানাতে কঠোরতার পথ বেছে নেবে। তাদের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শাসনামলে নারীরা কাজে যেতে পারতেন না। শাস্তি হিসেবে পাথর নিক্ষেপ, বেত্রাঘাত ও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা চালু করেছিল তারা।
নাসিম জাভিদ আরও বলেন, ‘সবচেয়ে কঠিন হবে অল্প বয়সী নারীদের জন্য। আমি অনেক মেডিকেল ছাত্রীকে চিনি, যারা ভালো চিকিৎসক হয়ে উঠতে পারত, কিন্তু এখন তারা বুঝতে পারছে না কীভাবে লেখাপড়া শেষ করবে।’
এই শহরেও তালেবান যোদ্ধারা লুটপাট চালাচ্ছেন বলে জানান তিনি। নাসিম জাভিদ বলেন, তাঁর এক আত্মীয়ের দামি একটি গাড়ি রাস্তা থেকে নিয়ে গেছে তালেবান। তারা তাঁকে জোর করে গাড়ি থেকে বের করে দেয়।
বিপুল অর্থ নিয়েছেন আশরাফ গনি
আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশত্যাগের সময় চারটি গাড়ি ও একটি হেলিকপ্টার ভরে নগদ অর্থ নিয়ে গেছেন বলে কাবুলে রাশিয়া দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। দূতাবাসের মুখপাত্র নিকিতা ইশচেঙ্কোর বরাত দিয়ে রুশ বার্তা সংস্থা আরআইএ বলেছে, ‘চারটি গাড়ি ভরা নগদ অর্থ ছিল। তাঁরা নগদ অর্থের একাংশ একটি হেলিকপ্টারে ঢোকানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু জায়গা হয়নি। নগদ অর্থের একটা অংশ বিমানবন্দরের টারমাকে ফেলে গেছেন।’
তোপের মুখে বাইডেন
এভাবে আফগানিস্তানকে তালেবানের হাতে ছেড়ে দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কঠোর সমালোচনা হচ্ছে। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান পার্টির রাজনীতিবিদসহ মার্কিন গণমাধ্যমও বাইডেনের সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এমন প্রস্থানকে লজ্জাজনক মনে করছেন মার্কিনরা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম পলিটিকোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন আইনপ্রণেতারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও জয়েন্ট চিফ অব স্টাফকে তাঁদের অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। যথাযথ পরিকল্পনা না থাকার কারণেই আফগানিস্তানে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রশাসনকে দোষারোপ করেছেন তাঁরা।
নেতৃত্বের ব্যর্থতার জন্য এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে মন্তব্য করে বাইডেনের পদত্যাগ দাবি করেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে সব দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। আফগানিস্তান যেন আবার বৈশ্বিক সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্য না হয়ে ওঠে, তা নিশ্চিতেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। আফগানিস্তানকে এভাবে তালেবানের হাতে ছেড়ে দেওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
তালেবানের ক্ষমতা দখলকে বিশ্বের ব্যর্থতা হিসেবে বর্ণনা করেছে যুক্তরাজ্য। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেছেন, আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের কাজ অর্ধসমাপ্ত রেখেই চলে যাওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই জানি, আফগানিস্তান শেষ হয়নি। বিশ্বের জন্য এ সমস্যা এখনো রয়ে গেছে এবং এখানে সবার সহযোগিতা দরকার।’
তালেবানের এ দখলকে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় হিসেবে দেখছে ইরান। ইরানের কট্টরপন্থী নতুন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে শান্তি ফেরার সুযোগ তৈরি হয়েছে।