আফ্রিকায় ঘাঁটি গাড়তে তৎপর চীন

প্রশান্ত মহাসাগরে চীন ও রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ মহড়া চালাচ্ছে।
ছবি : রয়টার্স

বৈশ্বিক সামরিক শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার পথে এগিয়ে চলেছে চীন। এ পথচলায় আফ্রিকায় আরও বেশি সামরিক ঘাঁটি গড়ার দিকে নজর দিচ্ছে দেশটি। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে সেসব তথ্য।

জিবুতিতে সামরিক উপস্থিতি প্রতিষ্ঠার প্রায় পাঁচ বছর পর সেখানে লুওমাহু নামের একটি জাহাজ পাঠিয়েছে চীন। এটি কোনো আড়ম্বরপূর্ণ বা গুরুত্ব বহন করার মতো তথ্য নয়। কিন্তু যে জাহাজ সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে, তার তাৎপর্য অনেক।

যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষকেরা বলছেন, এডেন উপসাগরে চীনের ১ হাজার ১০০ ফুটের যে নৌযান মোতায়েন করা হয়েছে, তা যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ কিংবা পারমাণবিক সাবমেরিন ঠেকাতে সক্ষম। এর বাইরে তানজানিয়াতেও চীন এক হাজার কোটি মার্কিন ডলারের গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এতে সেখানে একই রকম ক্ষমতার আরও রণতরি রাখতে পারবে চীন।

মার্কিন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারত মহাসাগরের চারদিকে চীন তার সামরিক বিস্তৃতি বাড়াতে চায়। ইতিমধ্যে ইকুয়েটরিয়াল গিনিতে একটি সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করা নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে বেইজিং। এটি চীনের নৌবাহিনীকে আটলান্টিক উপকূলে উপস্থিতি জানান দেওয়ার সুযোগ করে দেবে। অন্যান্য স্থানেও এমন সুযোগ নেওয়ার সন্ধানে আছে দেশটি। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর আফ্রিকা কমান্ডের প্রধান জেনারেল স্টিফেন টাউনসেন্ড মার্কিন সিনেটরদের বলেন, উত্তরের মৌরিতানিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিণের নামিবিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে চীন।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য একসময় যা করেছিল, সেই একই ভূমিকা পালন করছে চীন। নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ, জনগণ ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে তারা।

যুক্তরাষ্ট্রকে টক্কর দেওয়ার মতো বৈশ্বিক পরাশক্তি হতে চায় চীন। বিষয়টি পরিষ্কার। জিবুতিতে চীনের সামরিক ঘাঁটি তৈরির পর থেকে আফ্রিকা অঞ্চলে সামরিক কার্যক্রম বাড়িয়েছে দেশটি। যদিও চীনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা জলদস্যুতা ঠেকানোর প্রচেষ্টা হিসেবে এ পদক্ষেপ নিচ্ছে। ২০১৮ সালে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বেইজিংয়ে চীন-আফ্রিকা প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ফোরামের বৈঠক আয়োজন করেছিল। এতে আফ্রিকার ৫০টির মতো দেশ অংশ নেয়। ফোরামের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর জন্য সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় বৈঠকে। একই বছর চীনের পক্ষ থেকে ক্যামেরুন, গ্যাবন, ঘানা ও নাইজেরিয়ায় সামরিক মহড়া চালানো হয়। পরের বছর চীন যৌথভাবে তানজানিয়ার সঙ্গে সামরিক মহড়া করে। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা ও রাশিয়ার সঙ্গে ত্রিদেশীয় মহড়া চালায় দেশটি।

ইকুয়েটোরিয়াল গিনির বাটায় গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরিতে কাজ করছে চীন।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, চীন এখন আফ্রিকার বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আফ্রিকার ২১টি দেশে অস্ত্র বিক্রি করেছে বেইজিং। অন্য কোনো দেশ সেখানে এত অস্ত্র বিক্রি করতে পারেনি। বিক্রি করা অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে রুয়ান্ডার কাছে ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, নাইজেরিয়ার কাছে সাঁজোয়া যান প্রভৃতি। তবে আফ্রিকা অঞ্চলে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির দিক থেকে চীন দ্বিতীয়। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার দখল ৩০ শতাংশ, চীনের ২০ শতাংশ আর যুক্তরাষ্ট্রের ৫ শতাংশ। চীন অবশ্য সম্পর্ক ভালো রাখতে পুরোনো সরঞ্জাম দানও করে থাকে। ইতিমধ্যে এ কৌশলেই তানজানিয়া ও গিনিতে সামরিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং সেনাদের থাকার জায়গা গড়ে তুলেছে দেশটি।

জেনারেল টাউনসেন্ড বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যেখানে অনিচ্ছা দেখায়, সেখানে চীন প্রস্তুত থাকে। আফ্রিকার এক নেতা আমাকে বলেছেন, “ডুবন্ত ব্যক্তি বাঁচার জন্য যেকোনো হাত ধরতে প্রস্তুত থাকেন।” অনেক দেশের সরকারই সহিংস সন্ত্রাসী সংগঠনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে দেশকে নিরাপদ রাখতে চায়। তাই তারা যেকোনো প্রস্তাব লুফে নেয়। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার দ্রুত দেওয়া কোনো প্রস্তাব তারা ফেরাবে না।’ তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য পেতে গেলে অনেক শর্ত মানতে হয়; বিশেষ করে গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার শর্ত। কিন্তু অনেক গণতান্ত্রিক দেশও চীনের সাহায্য নিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, একজন মার্কিন কর্মকর্তা আফ্রিকার এক নেতাকে চীনের সাহায্য নিয়ে প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়তে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। কিন্তু ওই নেতা জবাবে বলেছিলেন, তাঁর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রয়োজন।

আফ্রিকায় চীনের ঘাঁটি গাড়তে চাওয়ার একটা লক্ষ্য হতে পারে ভারত মহাসাগর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ সরানো। এ জন্য আফ্রিকা হতে পারে ঘাঁটি গড়ার আদর্শ ক্ষেত্র।
রায়ান মার্টিনসন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউপোর্টের নেভাল ওয়ার কলেজের বিশেষজ্ঞ

তবে আফ্রিকায় চীনের সামরিক কার্যক্রমের প্রভাব এখনো অস্পষ্ট। চীন রাশিয়ার মতো অস্থিতিশীল শক্তি নয়। চীন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষার কর্মসূচিতে অংশ নেয়। রাশিয়ার কুখ্যাত ওয়াগনার গ্রুপের মতো কোনো দুর্বৃত্ত ভাড়াটে সেনা নেই। আফ্রিকার প্রতিটি দেশে অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে চীন স্থিতিশীলতা চায়; বিশৃঙ্খলা নয়।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য একসময় যা করেছিল, সেই একই ভূমিকা পালন করছে চীন। নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ, জনগণ ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে তারা। ২০১১ সাল থেকে বাইরের দেশে সামরিক বিস্তৃতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে দেশটি। ওই বছরের মার্চে কেনিয়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠী আল শাবাবের হাতে পাঁচজন মারা যান। দুজনকে অপহরণ করা হয়। ওই অঞ্চলের মার্কিন কমান্ডার জেনারেল উইলিয়াম জানা বলেন, আল শাবাবের কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও চীনা সেনাবাহিনী সেখানে যুদ্ধ করতে যায়নি। তারা সেখানে নিরাপত্তার কাজ করছিল, সেটা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থের অনুকূলে গেছে। এর কারণ হচ্ছে, কেনিয়াসহ চীনের আফ্রিকার সহযোগীরা। তারা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মার্কিন সেনাদের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক। কিন্তু চীনকে অনেক দেশ নিরাপত্তা সহযোগীর ভূমিকায় চায়।

এ ক্ষেত্রে ইথিওপিয়ার তাইগ্রে অঞ্চলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারের লড়াইকে উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। এক সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ইথিওপিয়ায় মার্কিন স্বার্থ নিয়ে কথা বলেন। চীন দেশটির অখণ্ডতা নিয়ে উদ্বেগে ছিল। উদ্বেগে ছিল যুক্তরাষ্ট্রও। কিন্তু শান্তি আলোচনার পরিবর্তে চীন ইথিওপিয়ার শাসক আবি আহমেদকে ড্রোন দিয়ে সাহায্য করেছে।

জিবুতিতে তৈরি সামরিক ঘাঁটিতে চীনা সেনারা। ২০১৭ সালের আগস্টে প্রথম চীনা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এই ঘাঁটিতে যান।

আফ্রিকায় চীনের সেনাবাহিনী যদি নিঃস্বার্থ নিরাপত্তারক্ষীর ভাবমূর্তি তৈরি করতে চায়, তবে জিবুতিতে তাদের শুরুটা ভালো হয়নি। তারা ঘাঁটি তৈরির জন্য জলদস্যু নিধনের পটভূমি তৈরি করেছে। সেখানে আগে থেকেই মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। আফ্রিকায় এটিই একমাত্র মার্কিন ঘাঁটি। জিবুতিতে ফ্রান্স, ইতালি ও জাপানেরও ঘাঁটি আছে। কিন্তু চীনের সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে তাদের সঙ্গে মেলানো যাবে না। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছিল, লেজার দিয়ে তাদের সামরিক জাহাজকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে। জিবুতি এতে বিরক্ত হয়। কিন্তু চীন এমন আচরণ থেকে সরে এসেছে। মার্কিন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জিবুতিতে চীনের উপস্থিতি যতটা না জলদস্যু ঠেকানোর উদ্দেশ্যে, তার চেয়ে বেশি কীভাবে বিদেশে ঘাঁটি চালাতে হয় ও শক্তি বাড়ানো যায়, তা ঠিকভাবে শেখার উদ্দেশ্যে।

চীন আরও ঘাঁটি গাড়বে অবশ্যই। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ হু বোর মত সেটাই। তাঁর ভাষ্য, চীনের সেনাবাহিনী বৈশ্বিক পর্যায়ে ক্ষমতার বণ্টনে আগ্রহী। অবশ্য কিছু চীনা বিশ্লেষক বৈদেশিক কৌশলে চীন আরও আগ্রাসী হতে পারে বলে মনে করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউপোর্টের নেভাল ওয়ার কলেজের রায়ান মার্টিনসন বলেন, আফ্রিকায় চীনের ঘাঁটি গাড়তে চাওয়ার একটা লক্ষ্য হতে পারে ভারত মহাসাগর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ সরানো। এ জন্য আফ্রিকা হতে পারে ঘাঁটি গড়ার আদর্শ ক্ষেত্র।

নেভাল ওয়ার কলেজের আরেক বিশ্লেষক আইজ্যাক কার্ডন বলেন, আফ্রিকার ৩০টি দেশে ৬১টি বন্দরে অর্থায়ন, নির্মাণকাজ বা এগুলো পরিচালনার সঙ্গে চীন যুক্ত। চীনের রণতরি এসব জায়গার বেশ কয়েকটিতে গেছে। মার্কিন কর্মকর্তারা এসব বন্দরকে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহারে অনুমতি দেওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করতে চাইছেন।

তাইওয়ানের আকাশে চীনের যুদ্ধজাহাজের মহড়া

অবশ্য আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশ বিশ্বের বৃহত্তম পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করতে আগ্রহী নয়। তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট সামিয়া সুলুহু হাসান গত এপ্রিলে ওয়াশিংটন সফর করেছেন। তিনি হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করেন, দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য কোনো ছাড় দেবেন না। এরপরও মার্কিন কর্মকর্তারা সংশয়ে রয়েছেন। তানজানিয়া হয়তো চীনকে তাদের বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেবে। ইকুয়েটরিয়াল গিনি চীনকে সামরিক ঘাঁটি গড়তে অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তবে দেশটির উপকূলে জলদস্যুদের হামলা বেড়ে যাওয়ায় চীন সুযোগ পেয়েছে। সেখানে এক চীনা কোম্পানি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করছে। সেখানকার দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরশাসক অর্থ চান। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ২০১৯ সালে দেশটিতে বেলআউট অনুমোদন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা দেশটির প্রেসিডেন্ট তেওডোরো ওবিয়াং এনগুয়েমা এমবাসোগোর পরিবারের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছে।

সাত মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা পরামর্শক জন ফাইনার গিনিতে চীনের সামরিক ঘাঁটি গড়ার বিরুদ্ধে সে দেশের সরকারকে নিরুৎসাহিত করছেন। এ জন্য দেশটি সফরও করেছেন তিনি। অবশ্য এরপর ওবিয়াংকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ফোন করে আশ্বস্ত করেছেন।

আফ্রিকা মহাদেশ থেকে চীন ভালো যা কিছু চায়, তার বিনিময়ে আফ্রিকার নেতারা দর-কষাকষি করতে পারেন। চীনের কৌশলগত লক্ষ্য সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র যত উদ্বেগ প্রকাশ করে, তার বিনিময়েও বাড়তি সুবিধার জন্য নেতারা করতে পারেন দর-কষাকষি। তবে এখন চীনের কৌশল, তারা আফ্রিকা মহাদেশে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করতে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছে, তা দেখানো। আফ্রিকার নেতারা বলছেন, তাঁরা চোখ-কান খোলা রেখেই চীনের সঙ্গে চুক্তিতে যাচ্ছেন। সেখানে নিজেদের স্বার্থই আগে দেখছেন তাঁরা।

ইকোনমিস্ট অবলম্বনে মো. মিন্টু হোসেন