বেশি দিন আগের কথা নয়। এই সেদিনও ওসামা বিন লাদেনের জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদাকে নিয়ে বিশ্ববাসীর দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। সেই দুর্ধর্ষ আল-কায়েদার নাম-ডাক এখন আক্ষরিক অর্থেই চাপা পড়েছে সুন্নি আরব জঙ্গিদের সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিস্ময়কর উত্থানে। এই নৃশংস গোষ্ঠীটির ভেতর-বাহির অনুসন্ধান করেছে বিবিসি।
জন্ম: জর্ডানের নাগরিক আবু মুসাব আল জারকাবি ২০০২ সালে তাওহিদ ওয়া আল-জিহাদ প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর আগ্রাসনের পরের বছর ওসামা বিন লাদেনের আনুগত্য গ্রহণ করেন জারকাবি। একই সঙ্গে তিনি আল-কায়েদা ইন ইরাক (একিউআই) গঠন করেন। পরবর্তী সময়ে দেশটিতে জঙ্গি তৎপরতায় একটি বড় শক্তিতে পরিণত হয় একিউআই।
২০০৬ সালে মারা যান জারকাবি। তাঁর মৃত্যুর পর একিউআই একটি সমন্বিত সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। নাম দেওয়া হয় ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক (আইএসআই)। একপর্যায়ে আইএসআই দুর্বল হয়ে পড়ে।
২০০২ সালে আইএসআইয়ের নেতৃত্ব নেন আবু বকর আল-বাগদাদি। তিনি সংগঠনটিকে পুনর্গঠন করেন। ২০১৩ সালনাগাদ সংগঠনটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তারা ইরাকে একাধিক হামলা চালায়। একই সঙ্গে সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগ দেয় গোষ্ঠীটি। সেখানে তারা আল নুসরা ফ্রন্ট গঠন করে।
২০১৩ সালের এপ্রিলে সিরিয়া ও ইরাকে নিজের বাহিনীকে অঙ্গীভূত করার ঘোষণা দেন বাগদাদি। এর মধ্য দিয়ে গঠিত হয় ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভেন্ট (আইএসআইএল) বা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইএসআইএস)।
আল নুসরা ও আল-কায়েদার নেতারা বাগদাদির এই পদক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করেন। বাগদাদির অনুগত যোদ্ধারা আল নুসরা ফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে আইএসআইএস নামে সিরিয়ায় তাদের অবস্থান বজায় রাখে।
২০১৩ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে আইএসআইএস তাদের দৃষ্টি ইরাকে ফিরিয়ে আনে। দেশটির শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে সংখ্যালঘু সুন্নি আরব সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক বিরোধের সুযোগ নেয় আইএসআইএস। আদিবাসীদের সহযোগিতায় ইরাকের ফালুজা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয় এই জঙ্গিগোষ্ঠী। চলতি বছরের জুনে ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল দখল করে নেয় তারা। এরপর ইরাকের সরকারি বাহিনীকে হটিয়ে একের পর শহর-অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় আইএসআইএস। ইরাক ও সিরিয়ায় নিজেদের দখলে থাকা অঞ্চল নিয়ে ২৯ জুন ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় তারা। একই সঙ্গে সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ইসলামিক স্টেট (আইএস)। সংগঠনের প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি তাদের খলিফা। তাদের রাজধানী সিরিয়ার আল-রাকাহ শহর।
লক্ষ্য: ইরাক, সিরিয়া, জর্ডান ও লেবাননের অংশবিশেষ নিয়ে একটি অঞ্চলজুড়ে ‘খিলাফত’ পদ্ধতির ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে আইএস। তাদের সেই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে শরিয়া আইনের ভিত্তিতে। লক্ষ্য অর্জনে সংগঠনটির নেতা আবু বকর আল-বাগদাদির প্রতি আনুগত্য প্রকাশে মুসলিম বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আইএস। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে তাদের মিত্রও তৈরি হয়েছে।
নিয়ন্ত্রণ: ইরাক ও সিরিয়ার প্রায় ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা আইএসের দখলে আছে বলে কেউ কেউ ধারণা করেন।
কারও কারও মতে, সংগঠনটি প্রায় ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। এই এলাকায় প্রায় ৮০ লাখ মানুষের বাস। দখলকৃত এলাকায় কঠোর শরিয়া আইন কার্যকর করেছে আইএস। ইরাক ও সিরিয়ার বাইরে লেবাননেও তৎপর গোষ্ঠীটি।
যোদ্ধা: আইএসে প্রায় ১৫ হাজার সক্রিয় যোদ্ধা রয়েছে বলে মার্কিন কর্মকর্তাদের ধারণা। তবে ইরাকি বিশেষজ্ঞ হিসহাম আল হাসহিমির ধারণা, আগস্টের শুরুর দিকে আইএসে প্রায় ৩০-৫০ হাজার যোদ্ধা ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মতাদর্শগত যোদ্ধা। অন্যরা ভয়ে বা বাধ্য হয়ে আইএসে যোগ দিয়েছে। তবে কারও কারও মতে, আইএসের প্রায় ৮০ হাজার প্রশিক্ষিত যোদ্ধা আছে। এর মধ্যে সিরিয়ায় আছে ৫০ হাজার এবং ইরাকে ৩০ হাজার।
আইএস যোদ্ধাদের একটা বড় অংশ ইরাক ও সিরিয়া সীমান্তে যুদ্ধ করছে। এই জঙ্গি গোষ্ঠীটিতে ৮১টি দেশের ১২ হাজারেরও বেশি বিদেশি যোদ্ধা রয়েছে। এর মধ্যে আড়াই হাজার যোদ্ধা পশ্চিমা দেশগুলো থেকে এসেছে।
অস্ত্র: আইএসের যোদ্ধারা হালকা থেকে ভারী সব ধরনের অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। তারা ট্রাকে স্থাপিত মেশিনগান, রকেট লঞ্চার, বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র, ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে সক্ষম। তাদের কাছে জঙ্গি হেলিকপ্টার, পরিবহন বিমান ও অত্যাধুনিক সব সমরাস্ত্র আছে। সিরিয়া ও ইরাকি বাহিনীর কাছ থেকে দখল করা ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ব্যবহার করছে আইএস।
অর্থ: আইএসের প্রায় ২০০ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের নগদ অর্থ বা সম্পদ রয়েছে। এই সুবাদে তারা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী জঙ্গি গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
আইএসের আয়ের একটা বড় অংশ আরব গালফ রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের কাছ থেকে আসে। তা ছাড়া এখন তারা নিজেরাই আয় করে। ইরাক ও সিরিয়ায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকার তেল ও গ্যাসক্ষেত্র থেকে লাখ লাখ ডলার আয় করে গোষ্ঠীটি। এর বাইরে শুল্ক, টোল, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, অপহরণ এবং দখলকৃত এলাকার ব্যাংকগুলো থেকে তারা বিপুল অর্থ আয় করে। আটলান্টিক কাউন্সিলের ফেলো ফয়সাল ইতানির ধারণা, আইএসের তহবিল ও আয়ের সিংহভাগ আসে অভ্যন্তরীণভাবে।
নৃশংসতা: সম্প্রতি ইরাক ও সিরিয়ায় গণহত্যা চালিয়ে ব্যাপক কুখ্যাতি অর্জন করেছে আইএস। এসব গণহত্যার চিত্র ইন্টারনেটে প্রকাশ হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় ওঠে। মার্কিন সাংবাদিক জেমস ফলি ও স্টিভেন সটলফকে শিরশ্ছেদে হত্যার মধ্য দিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আঘাত হেনেছে আইএস। এ ঘটনাকে ‘সন্ত্রাসবাদী হামলা’ বলে অভিহিত করেছে ওয়াশিংটন। আইএসের হুমকি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একমত হয়েছে।