যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা কী? একই প্রশ্ন করা যেতে পারে জাপান, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের বেলায়। এর উত্তর দেওয়াটা সহজ নয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নটির মীমাংসা করতে গিয়ে একেকজন একেক সমস্যার কথা তুলে ধরবেন।
বস্তুবাদীরা হয়তো বলবেন দশকব্যাপী গড় আয়ে ধীর প্রবৃদ্ধির কথা, যা শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়িয়ে তুলছে। বিদ্যমান অর্থনীতির গুরুরা সামনে আনবেন বিপুল ঋণের বিষয়টি, যা পেনশন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার মতো সামাজিক প্রকল্পের কারণে দিন দিন বেড়েই চলেছে।
এসব সমস্যার হিসাব-নিকাশের পাশেই অবধারিতভাবে বসে থাকবে অভিবাসনের মতো সমস্যা, যার ছায়া নীতিপ্রণেতাদের প্রচারের দোষে দিন দিন বড় হয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলছে দেশগুলোর সাধারণ মানুষকে, যা লোকরঞ্জনবাদের এক অবধারিত উপাদান হয়ে উঠেছে। সমস্যার এই বহুবিচিত্র ব্যাপ্তি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপ—সব ধনী দেশের জন্যই আজ সত্য। একই সঙ্গে এই সমস্যাগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক অবস্থানে বিস্তর পার্থক্য থাকাটাও একটি বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। ধনী দেশগুলোয় ক্রমে বড় হয়ে ওঠা এসব সমস্যা এবং এগুলো মোকাবিলায় গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ সমস্যাগুলোকে আর সীমান্তে আটকে রাখছে না। এ–ই যখন বাস্তবতা, তখন সম্পূর্ণ না হলেও প্রায় বিপরীত অবস্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু কীভাবে?
গড় আয়ের সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি, নিম্ন রাষ্ট্রীয় ঋণ, ঝুঁকিহীন কল্যাণ রাষ্ট্রের কাঠামো, অভিবাসনসহ এই সবকিছুর প্রতি জনসমর্থন—এগুলোর সহাবস্থান বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় একটি ধনী রাষ্ট্রের জন্য স্বপ্নসম। অধিকাংশ পাশ্চাত্য দেশের জন্যই এ বিষয়গুলোর সহাবস্থান কল্পনাতেও আনা সম্ভব নয়। কিন্তু ঠিক এ কাজই করে দেখাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া।
বিশ্বের যেকোনো অঞ্চল থেকে তুলনামূলক দূরবর্তী আড়াই কোটি জনসংখ্যার এই দেশের কথা উঠলেই সবার চোখে ভেসে ওঠে ক্যাঙারুর ছবি। ক্রিকেটের কারণেও আলোচনায় আসে দেশটি; কিন্তু তা শুধু ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোতেই। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিশ্বে ক্রিকেট খেলে অল্প কটি দেশ। ফলে বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রে দেশটি তেমন থাকে না। কিন্তু থাকাটাই উচিত। কারণ অর্থনীতি।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ধনী দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি তর্কযোগ্যভাবে সবচেয়ে সফল। কোনো মন্দা ছাড়াই ২৭ বছর ধরে দেশটির অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি দেখছে, যা কোনো ধনী দেশের জন্য একটি রেকর্ড। এই সময়ের মধ্যে দেশটির সার্বিক প্রবৃদ্ধি ছিল একই সময়ে জার্মানির প্রবৃদ্ধির তিন গুণ। একই সময়ে আমেরিকার গড় আয়ের চেয়ে চার গুণ বেশি গতিতে দেশটির গড় আয় বেড়েছে। আর সরকারি ঋণের পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ৪১ শতাংশ, যা কিনা যুক্তরাজ্যের অর্ধেক।
এমন আকর্ষণীয় একটি অর্থনীতি এমনি এমনি অর্জিত হয়নি। অবশ্য ভাগ্যের কথাও বলতে হবে। কারণ, অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে লোহার বড় খনি। রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস, আর চীনের সঙ্গে তুলনামূলক সুসম্পর্ক। এর সঙ্গে নীতি ধারাবাহিকতা মণিকাঞ্চনযোগের কাজ করেছে। ১৯৯১ সালে সর্বশেষ মন্দার পর দেশটির সরকার স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পেনশনব্যবস্থা ঢেলে সাজায়, যেখানে এ খাতে মধ্যবিত্তের অবদান রাখার সুযোগ বাড়ানো হয়। এর ফল পাওয়া গেছে হাতেনাতে। কারণ, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় পেনশনের জন্য জিডিপির যে অংশ ব্যয় হয়, তা ওইসিডিভুক্ত (৩৪ দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা) দেশগুলোর অনুরূপ গড় হারের অর্ধেক। আগামী বছরগুলোয় এ ব্যবধান আরও বাড়বে।
এ ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসনবান্ধব পরিবেশের কথা উল্লেখ করতে হয়। ধনী দেশগুলোয় যেখানে অর্থনৈতিক যেকোনো সংকটের কারণ হিসেবে অভিবাসনকে দায়ী করার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়া সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ২০১৫ সালে পরিচালিত শুমারি অনুযায়ী দেশটির প্রায় ২৯ শতাংশ অধিবাসীরই জন্ম অন্য কোনো দেশে, যা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ। অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যার অর্ধেকই হয় অভিবাসী, নয়তো অভিবাসীর সন্তান। এই অভিবাসীদের অধিকাংশই আবার এসেছে এশিয়া থেকে, যা দেশটির জনমিতিকেই বদলে দিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার এই অবস্থানকে বুঝতে হলে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইতালির মতো দেশগুলোর দিকে তাকাতে হবে, যেখানে অল্পসংখ্যক অভিবাসীর প্রবেশই বদলে দিতে পারে ভোটের হিসাব-নিকাশ। আর জাপানে অভিবাসী গ্রহণের বিষয়টি এখনো রাজনৈতিক ট্যাবু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর অস্ট্রেলিয়ায় সরকারি ও বিরোধী দল উভয়েই দক্ষ অভিবাসী গ্রহণকে অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখে।
অবশ্য এমন নয় যে অস্ট্রেলিয়ায় এই সবকিছুই একেবারে সংকটহীনভাবে চলছে। ইকোনমিস্টের মতে, অস্ট্রেলীয়দের নিজেদের অবসরোত্তর জীবনের জন্য সঞ্চয় করতে হয়। ব্যক্তিগত বিনিয়োগ তহবিলের নামে তাদের কাছ থেকে কেটে নেওয়া হয় বিপুল অর্থ। অথচ পেনশনজীবীরাও ভালো নেই। একরকম দরিদ্র অবস্থাতেই তাঁদের দিনাতিপাত করতে হয়। প্রশ্ন রয়েছে অভিবাসনের ক্ষেত্রেও। নিয়ম মেনে সঠিক পথে অভিবাসী হলে ঠিক আছে। কিন্তু নৌকায় চেপে, বৈধ কাগজপত্র ছাড়া অভিবাসী হতে চাইলে তাঁর প্রতি সদয় নয় অস্ট্রেলিয়া। মূল ভূখণ্ডে এ ধরনের অভিবাসনপ্রত্যাশীদের গ্রহণ করা হয় না। তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো এক দ্বীপে, যেখানে এমনকি বৈধ শরণার্থীদেরও পাঠানো হয় বছরের পর বছর পচে মরতে।
রয়েছে আরও নানা সমস্যা, যার মীমাংসা হওয়া উচিত হলেও এখনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অস্ট্রেলীয়রা, বহু বছর ধরে সমস্যাসংকুল জীবনযাপনই যাদের নিয়তি, যার মীমাংসায় কোনো সরকারই উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে খরার চক্রে পড়ে আছে দেশটি; রয়েছে অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগও। কিন্তু গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে তেমন কিছুই করেনি দেশটি।
সবকিছুর পরও অস্ট্রেলিয়ার উদাহরণটি সামনে আসছে এই কারণে যে অর্থনৈতিক মন্দা বা তার আশঙ্কা যেখানে অন্য ধনী দেশগুলোকে নীতি সংস্কারের বদলে রক্ষণশীল নীতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সেখানে অস্ট্রেলিয়ার সরকার সর্বশেষ মন্দার সময় গৃহীত বিভিন্ন সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে এবং তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে একটি সন্তোষজনক অর্থনীতির উদাহরণ সামনে রেখেছে। ২০১৬ সালে দ্য কনভারসেশনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯১ সালে মন্দা থেকে উত্তরণের জন্য কতগুলো বিশেষ দিকের দিকে মনোযোগ দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। সে সময় দেশটির নীতিপ্রণেতারা মুদ্রাস্ফীতি, বাণিজ্য ভারসাম্য, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উৎসাহিতকরণসহ একগুচ্ছ পরিকল্পনা নেয়। সমন্বিত ওই পরিকল্পনার ফল এখন পাচ্ছে তারা। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসেও রেকর্ড পরিমাণ রপ্তানি আয় করেছে দেশটি। সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের তথ্যমতে, সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার চীনের আমদানি কমে গেলেও সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার রপ্তানি বেড়েছে; পণ্য ও অর্থের পরিমাণ—দুই বিবেচনাতেই।
যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যায় ডেমোক্র্যাটরা পেনশন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির বিরোধিতার নীতি নেয়। অস্ট্রেলিয়ায় একই নীতি নেয় বামপন্থীরা। যুক্তরাষ্ট্রে যে নীতির কথা বলা হলেও নানা সংকটের কারণে কার্যক্ষেত্রে অনুপস্থিত থেকে যায়, অস্ট্রেলিয়ায় তা-ই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার লেবার পার্টি কর্মীদের পেনশনের স্কিমটি সরাসরি বিক্রি করে কর্মীদের কাছে, যা কর্মী বা শ্রমিকের হয়ে কিনে নেন মালিক। আর যেসব কর্মী কখনোই নিজের চলার মতো একটি সঞ্চয় গড়ে নিতে পারেননি, তাঁদের জন্য রয়েছে সরকারি তহবিল।
তবে বর্তমানে পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। কারণ, এক দশক আগে বৈশ্বিক মন্দা থেকে যে চীন অস্ট্রেলিয়াকে উদ্ধার করেছিল, সেই চীন এখন সংকটে। আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে দেশটির উৎপাদন খাতে সংকট চলছে। ফলে, অস্ট্রেলিয়ার রপ্তানি খাত সংকুচিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে ধনী দেশগুলোয় অভিবাসনবিরোধী যে ঢেউ তৈরি হচ্ছে, তাও এসে অস্ট্রেলিয়ায় লাগতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ায়ও অভিবাসন সংকোচন নীতি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে বলে দ্য অস্ট্রেলিয়ানে লেখা নিবন্ধে মত প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ জুডিথ স্লোয়ান। চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য–লড়াই বিবেচনায় নিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথাও বলছেন বিশ্লেষকেরা।
তবে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে এর রাজনৈতিক ব্যবস্থা। ইকোনমিস্ট বলছে, অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থা বরাবরই মধ্যপন্থীদের পুরস্কৃত করে। কারণ, আইন অনুযায়ী সব ভোটারই ভোট দিতে বাধ্য। আবার অস্ট্রেলিয়ায় ভোটাররা কোনো এক ব্যক্তিকেই শুধু ভোট দেন না; তাঁরা মূলত সব প্রার্থীকে নিয়েই নিজের পছন্দানুসারে একটি তালিকা জমা দেন। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে কোনো একটি বিষয়ে কট্টর হয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব। আর এই রাজনৈতিক পরিবেশই দেশটির রাজনীতিকদের যেকোনো একটি বিষয়ে বিভিন্ন মত শোনার কান তৈরি করে দিয়েছে। দীর্ঘ চর্চার কারণে নেতাদের বিভিন্ন নীতি ও তার প্রভাব নিয়েও ভোটারদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। এটিই বিরুদ্ধ পরিবেশে অস্ট্রেলিয়ার এগিয়ে যাওয়ার মূলে কাজ করছে, যা শেখা উচিত গোটা বিশ্বের।