অপরাধী প্রত্যর্পণ আইন নিয়ে উত্তাল হংকং

চীনের প্রভাব বৃদ্ধির আশঙ্কায় প্রস্তাবিত প্রত্যর্পণ আইনের প্রতিবাদে উত্তাল হংকং। ছবি: রয়টার্স
চীনের প্রভাব বৃদ্ধির আশঙ্কায় প্রস্তাবিত প্রত্যর্পণ আইনের প্রতিবাদে উত্তাল হংকং। ছবি: রয়টার্স

অপরাধী প্রত্যর্পণ আইন নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছে হংকং। নতুন এ আইন অনুযায়ী চীন চাইলে সন্দেহভাজন অপরাধীদের নিজ ভূখণ্ডে নিয়ে বিচারের মুখোমুখি করতে পারবে।

প্রস্তাবিত এ আইনের প্রতিবাদে আজ রোববার হংকংয়ের পথে নেমে এসেছে হাজারো বিক্ষুব্ধ জনতা। ২০১৪ সালের আমব্রেলা মুভমেন্টের পর এটিই সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ।
বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, হংকংয়ে বিরোধীপক্ষকে শায়েস্তা করতে চীন প্রস্তাবিত আইনটিকে ব্যবহার করবে বলে মনে করছে বিভিন্ন মহল। সাধারণ মানুষের মধ্যেও আইনটি ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তবে হংকং সরকার বলছে, আইনটিতে নাগরিকদের সুরক্ষার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রস্তাবিত আইনটি আগামী জুলাই মাসে পাস হতে পারে। আইনটি প্রস্তাব করেছেন হংকংয়ের নেতা ক্যারি ল্যাম। আইনের পক্ষাবলম্বনকারীরা বলছেন, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে কোনো ব্যক্তি যেন এই আইনের মাধ্যমে ক্ষতির শিকার না হন, তার সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে।
তবে আইনটির পক্ষাবলম্বনকারীদের এই প্রবোধ মানতে নারাজ সমালোচনাকারীরা। তাঁদের মতে, এ আইনের মাধ্যমে হংকংয়ের বিচার ব্যবস্থাই হুমকির মুখে পড়ছে। এর মাধ্যমে হংকংয়ের ওপর চীনের প্রভাব বাড়বে। হংকংয়ের যেকোনো ব্যক্তিকে শায়েস্তা করতে চীন এ আইন ব্যবহার করবে।
প্রস্তাবিত এ আইনের প্রতিবাদে রোববার রাস্তায় নেমে আসে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ব্যবসায়ী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা সবাই এ বিক্ষোভে অংশ নেন। অধিকাংশের পরনেই ছিল সাদা পোশাক। নতুন এ আইনকে হংকংয়ের স্বকীয়তা বজায় থাকা না থাকার প্রশ্ন বলে মনে করছেন আন্দোলনকারীরা।
আন্দোলনে যোগ দেওয়া ৫৯ বছর বয়সী অধ্যাপক রকি চ্যাং বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘এটা হংকংয়ের জন্য বাঁচা-মরার লড়াই। এ কারণেই আমি আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। এটা একটি কালো আইন।’
এ আইনকে নিজেদের স্বার্থবিরোধী হিসেবে দেখছেন সবাই। আন্দোলনকারীদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই বেশি। এ বিষয়ে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ইভান অং বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘মানুষের কথা শোনা হচ্ছে না। এ আইন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে হংকংয়ের মর্যাদাহানিই শুধু করবে না, এটি আমাদের বিচার ব্যবস্থাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’

বিক্ষোভে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ শামিল হন। ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত

২০১৪ সালে গণতন্ত্রপন্থীরা ৭৯ দিন ধরে হংকংয়ের প্রাণকেন্দ্রে বিক্ষোভ করলেও সরকারের কাছ থেকে কোনো দাবি আদায় করে নিতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। এবারের বিক্ষোভ জনসমাগমের দিক থেকে সে সময়ের বিস্তৃতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আন্দোলনকারীরা রাস্তায় বিভিন্ন দাবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ করছেন। তাঁরা একে অন্যকে সহযোগিতা করছেন। হুইলচেয়ারে করেও অনেকে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন, যাদের সহায়তা করছেন অন্য আন্দোলনকারীরা। সব মিলিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে আন্দোলনে নামলেও অনেকেই ঠিক পুরোপুরি আশাবাদী নন। কারণ, হংকংয়ের আইনসভায় বেইজিংপন্থীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
যে আইনটি নিয়ে এ আন্দোলন, সেখানে বলা হয়েছে, বেইজিং, ম্যাকাও ও তাইওয়ান থেকে পালিয়ে আসা কোনো অপরাধীকে ফেরত চাইলে তাকে ফেরত দিতে হবে। বিশেষত যেসব অপরাধীর বিরুদ্ধে হত্যা ও ধর্ষণের মতো অভিযোগ রয়েছে। তবে হংকংয়ের কর্তৃপক্ষ বলছে, এ আইন নিয়ে এত দুর্ভাবনার কিছু নেই। কারণ এ অপরাধী প্রত্যর্পণ অনুরোধে সাড়া দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি হংকংয়ের বিচার বিভাগই নেবে।
আন্দোলনের মুখে কিছু পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হতে পারে। হংকং কর্তৃপক্ষ বলছে, মানুষের উদ্বেগকে বিবেচনায় রেখে শুধু সাত বছর বা তদূর্ধ্ব মেয়াদের কারাদণ্ড হয়েছে এমন পলাতক অপরাধীদের প্রত্যর্পণের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।
তবে বিষয়টি এতটা সরল নয়। এ আইনের ফলে চীনা বিচার ব্যবস্থার অধীনে অন্যায্যভাবে আটক ও বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যাবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
এই সময়ে নতুন এ আইন প্রস্তাব আইনসভায় ওঠার একটি কারণ রয়েছে। বিবিসি জানাচ্ছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে হংকংয়ের এক ১৯ বছরের তরুণ তাইওয়ানে ছুটি কাটানোর সময় তাঁর প্রেমিকাকে হত্যা করে হংকংয়ে পালিয়ে আসেন। ওই তরুণকে বিচারের মুখোমুখি করতে তাইওয়ান ফেরত চাইলে হংকং থেকে এ সংক্রান্ত আইনি জটিলতার কথা তোলা হয়। এ প্রেক্ষাপটেই এ আইন প্রস্তাব করা হয়। যদিও তাইওয়ান বলছে, এ ঘটনার জন্য আইনে এত বড় পরিবর্তন না এনে ঘটনাটিকে পৃথকভাবে সমাধান করা উচিত।
প্রসঙ্গত, সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত হংকং ১৯৭৭ সালে চীনের অধীনে ফেরার পর থেকে ‘এক রাষ্ট্র দুই নীতি’র অধীনে পরিচালিত। গত দুই দশক ধরে অপরাধী প্রত্যর্পণ বিষয়ে চীনা সরকারের সঙ্গে আলোচনা চললেও এ ধরনের কোনো আইন প্রণীত হয়নি নিজস্ব আইনে পরিচালিত হংকংয়ে। যদিও যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ২০টি দেশের সঙ্গে হংকংয়ের একই ধরনের আইন রয়েছে।