অজানা গন্তব্যের পথে মিয়ানমার

ফাইল ছবি

ঠিক এক বছর আগে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে অং সান সু চির নির্বাচিত এনএলডি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং। মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী মানুষ ২ ফেব্রুয়ারি থেকে জলপাই সরকারের বিরুদ্ধে সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্স মুভমেন্টের (সিডিএম) অসহযোগের ডাক দেয়। স্প্রিং রেভল্যুশন বা ‘বসন্ত বিপ্লব’ শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন হলেও তাতে ব্যাপকভাবে হামলা চালায় সেনাবাহিনী। তরুণসহ সমাজের বিভিন্ন অংশ প্রতিরোধ গড়ে তোলার পর সেনাবাহিনীর নৃশংসতা বাড়তে থাকে। নগরকেন্দ্রিক আন্দোলনের রেশ একসময় ছড়িয়ে পড়ে মিয়ানমারের সবখানে। গত এক বছরে মিয়ানমার সেনাদের হাতে অন্তত দেড় হাজার বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর পাল্টা হিসেবে বিকল্প সরকার নামে পরিচিত এনইউজির সামরিক শাখা পিডিএফ তিন হাজার সেনাসদস্যকে হত্যার দাবি করেছে।

তাতমাদো নামে পরিচিত সেনাবাহিনীর নির্বিচার বলপ্রয়োগের পর থেকে মিয়ানমারের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়া জনতার প্রতিরোধ বাহিনীর (পিডিএফ) হামলা জোরালো হয়েছে। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে শিগগিরই আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এমন এক পরিস্থিতিতে এক অজানা গন্তব্যের পথে হাঁটছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি।

গত এক বছরে টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত আছে। গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির উন্নতি হলেও, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর পরিস্থিতি আবার আগের দিকেই যাচ্ছে। এক বছর আগে ১ হাজার ৩০০ চাট ছিল এক ডলারের বিনিময় মূল্য। সরকারি হিসাবে এখন ডলারের বিনিময়ে ১ হাজার ৭৮০ চাট। আর খোলা বাজারে এক ডলার সমান ২ হাজার ১০০ চাট। মাসের পর মাস লোকজন ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলতে পারছেন না।

ক্ষমতাচ্যুত আইনপ্রণেতাদের নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে হামলা জোরদারের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। এনইউজির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়ে মন ২০২২ সালের মধ্যে জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সরকারকে হটিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। মিয়ানমারের গণমাধ্যমে ইরাবতীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, ডিসেম্বরে তিনটি জেলায় পিডিএফের হামলায় সেনাবাহিনীর ২৯১ জন সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। হামলাগুলোতে পিডিএফ সদস্যও মারা গেছেন। সেনাবাহিনীর অন্তত দুই হাজার সদস্য পক্ষ ত্যাগ করে পিডিএফে যোগ দিয়েছেন। আরও অনেক সেনাসদস্য পিডিএফে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন। কাজেই এই বছরের মধ্যে মিয়ানমারের জনগণের বিজয় সুনিশ্চিত।

প্রসঙ্গত, ১৯৮৮ সালের ছাত্র বিক্ষোভের অন্যতম সংগঠক ইয়ে মন ২০১৫ এবং ২০২০ সালের নির্বাচনে নেপিডো থেকে অং সান সু চির দল এনএলডির টিকিটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত সোমবার ইয়ে মনের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করেছে ইরাবতী।

মিয়ানমারের দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের দেশটির জন্য ভয়াবহ বলে মন্তব্য করেছে ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)। আইসিজি গত বছরের অক্টোবরে ‘সামরিক শাসন-পরবর্তী মিয়ানমারে ভয়াবহ অচলাবস্থা’ শিরোনামে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, তাতমাদো এবং সামরিক শাসনের বিরোধীরা একে অন্যের বিরুদ্ধে যে সহিংসতা শুরু করেছে, তা আপাতত থামার কোনো লক্ষণ নেই। শহরাঞ্চলে গেরিলা কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের জন্য তল্লাশি এবং গ্রেপ্তারের মাত্রা ব্যাপক হারে বাড়িয়েছে সেনাবাহিনী।

আবার পিডিএফ তৎপর রয়েছে, এমন গ্রামাঞ্চলের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর নৃশংস হামলা চালাচ্ছে তাতমাদো। এর পাল্টা হিসেবে সামরিক বহরে চোরাগোপ্তা হামলা, সরকারি স্থাপনায় হামলার পাশাপাশি সামরিক জান্তার দোসরদের হত্যা করছে পিডিএফ। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের ফলে আলোচনার সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এর চূড়ান্ত ফলটা ভোগ করতে হবে মিয়ানমারের সাধারণ মানুষকে। অর্থনীতি গত এক বছরে যথেষ্ট খারাপ হয়েছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থা পর্যুদস্ত হওয়ার পাশাপাশি খাদ্যনিরাপত্তা ও দারিদ্র্য পরিস্থিতিও অবনতির দিকে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে তা মিয়ানমারের বাইরে এই অঞ্চলে প্রভাব ফেলবে। এমন এক প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংকট এবং চলমান সহিংসতা অবসানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। চ্যালেঞ্জিং কাজটি কূটনৈতিকভাবে বিভিন্ন দেশ ও জাতিসংঘকে নিতে হবে। মিয়ানমারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অগ্রাধিকার থাকাটা জরুরি।

তরুণ জনগোষ্ঠী ও প্রযুক্তি

গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সরকার ক্ষমতায় বসার পরদিনই শুরু হয় সিভিল ডিজঅবিডিয়েন্স মুভমেন্ট (সিডিএম)। ২ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনটি শুরু হয় ফেসবুকে প্রচারের মাধ্যমে। শুরুতেই অন্তত ২ লাখ ৩০ হাজার লোক সিডিএমের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। শুরুতেই এ আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। স্বাস্থ্যকর্মীরা হাসপাতালে এবং শ্রমিকেরা কারখানায় কাজ বন্ধ করে দেন। সেনাবাহিনীকে বয়কটের ডাক দিয়ে মাথায় লাল ফিতা বেঁধে ড্রাম বাজানো, মিছিল করাই ছিল আন্দোলনের মূল কর্মসূচি। আন্দোলনকারীদের মুখে উচ্চারিত থাকে ১৯৮৮ সালের বিক্ষোভের আলোচিত গান ‘কাবার মা কিয়াই বু’ (পৃথিবী ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত)। আর প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে তিন আঙুলের স্যালুট।

মিয়ানমারের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখেন এমন বিশ্লেষকদের মতে, এবারের আন্দোলনের বড় অংশটি তরুণ এবং শিক্ষিত। তাঁদের সঙ্গে ১৯৬০ কিংবা ১৯৮০-এর দশকের তফাত হচ্ছে, তাঁদের সবাই মোটামুটি গণতন্ত্রের স্বাদটা পেয়েছেন। পাশাপাশি তাঁরা প্রযুক্তির সঙ্গেও নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম আর প্রযুক্তি—দুইয়ের সম্মিলনের শক্তিকে জেনারেল মিন অং হ্লাইং এবং তাঁর দোসররা তুচ্ছ মনে করেছিলেন। ফলে শহরে নিপীড়নের মাত্রা বাড়তে থাকলে তাঁরা বিস্তীর্ণ জনপদে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেন। এসব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া তরুণের মধ্যে গায়ক, লেখক, পারফর্মিং আর্টিস্টসহ অনেকেই রয়েছেন, যাঁদের বিপুলসংখ্যক সমর্থক রয়েছে। পাশাপাশি শিল্প-কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকেরাও যুক্ত হয়ে গেছেন এই আন্দোলনে। সব মিলিয়ে তাঁরাই হয়ে উঠেছেন আন্দোলনের বড় শক্তি।

লক্ষ্য যখন সেনাবাহিনী

এনএলডি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর মিয়ানমারের আড়াই শর মতো গোষ্ঠী দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে, যারা নিয়মিতভাবে সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালাচ্ছে। এনইউজি গত সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জনযুদ্ধ ঘোষণার আগে থেকেই এসব হামলা চলছে। মূলত স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে এসব বাহিনী যুক্ত হয়েছে। যদিও এই গোষ্ঠীগুলো নিজেদের পিডিএফের অংশ হিসেবে দাবি করে থাকে। এসব গোষ্ঠীর অল্প কয়েকজন সদস্য যেমন আছে, তেমনি সুসংগঠিত মিলিশিয়া বাহিনীও রয়েছে। এদের হাতে ছোটখাটো আধুনিক অস্ত্র রয়েছে।

পিডিএফের আক্রমণের মূল লক্ষ্য সেনাবাহিনী এবং তাদের মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। এরই অংশ হিসেবে তারা রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিকম প্রতিষ্ঠান মাইটেলের ১২০টি টাওয়ার ধ্বংস করেছে। ওই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম মালিক সেনাবাহিনী। এ ছাড়া তারা বিদ্যুৎ সঞ্চালনের লাইন, সেতু ও রেলসংযোগে হামলা চালিয়েছে। নিয়মিত বিরতিতে বিক্ষিপ্তভাবে এই হামলা চালানো হয়েছে।

তবে বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার পাশাপাশি পিডিএফ সেনাবাহিনীর দোসরদেরও বেছে বেছে হত্যা করছে। গ্রামাঞ্চলে এরা নিয়মিতভাবে সেনাবহরে চোরাগোপ্তা হামলার পাশাপাশি বোমা ছুড়ে মারছে। আবার ইয়াঙ্গুনসহ বেশ কয়েকটি শহরে অতর্কিত সেনাবাহিনীর ট্রাকে বোমা হামলার পর সেনাবাহিনীর সদস্যদের গুলি করে হত্যা করেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিপক্ষ শক্তি বেশ উদ্ভাবনী কায়দায় নিজেদের রসদ সংগ্রহের কাজটি করছে। তারা থ্রিডি প্রিন্টার দিয়ে ডার্ক ওয়েভ থেকে সাবমেশিন ও পিস্তলের মডেলগুলোকে প্রিন্ট করে নেয়। এরপর ওই থ্রিডি গানের ভেতর অ্যালুমিনিয়াম বা মেটাল ব্যবহার করে একটি কার্যকর অস্ত্রে পরিণত করছে। মিয়ানমারের এসব গোষ্ঠী ডার্ক ওয়েভ থেকে মার্কিন একজন বিচ্ছিন্নতাবাদীর এফজিসি ৯ মডেলটি ব্যবহার করছে। এতে ৯টি বুলেট থাকে। এর পাশাপাশি এরা ড্রোনের ব্যবহার করছে নিয়মিতভাবে। ড্রোনের নিচের সুইচটাকে কনভার্ট করে হাতের মতো ব্যবহার করে গ্রেনেড বা বোমা বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করছে। ফলে কম জনবল ব্যবহার করে অনায়াসে এরা বড় হামলা নির্বিঘ্নে চালাচ্ছে।

জনশ্রুতি আছে, মূলত মিয়ানমারের প্রবাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছ থেকে পিডিএফসহ প্রতিরোধ বাহিনীর সদস্যরা আর্থিক সহায়তা পাচ্ছেন। বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আসছে। আবার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মাদক, মূল্যবান আকর, পাথর, জুয়া এবং স্থানীয় কর থেকে আয় রয়েছে। এসব টাকা থেকে এখন সরকারবিরোধী হামলায় সহায়তা করা হচ্ছে।

বড় ধাক্কাটা অর্থনীতিতে

সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর মিয়ানমারের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি তো বটেই, অর্থনীতি বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। বিদেশিদের আসা-যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া, বিনিয়োগকারীদের চলে যাওয়া, সব মিলিয়ে অর্থনীতির পরিস্থিতি ভালো হওয়ার কোনো আভাস নেই। মিয়ানমারে ২০১৫ সাল থেকে গড়ে প্রতিবছর ৪০ লাখ পর্যটক আসতেন। গত এক বছরে পর্যটকদের মিয়ানমার ভ্রমণ এক রকম বন্ধ হয়ে গেছে বলা যায়। কারণ, পর্যটনকেন্দ্রগুলোর আশপাশে পিডিএফ এখন যথেষ্ট সক্রিয়। মান্দালায়ের আশপাশে বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ বন্ধ করে দিয়েছেন। গড়ে পর্যটকদের মিয়ানমার সফরের হার ৫-এর কম। এই ধারা আরও ৬ মাস চলতে থাকলে বড় ধরনের ধস নামার আশঙ্কা হোটেল ব্যবসায়।

ফেব্রুয়ারির পর থেকে বিদেশিরা মিয়ানমার ভ্রমণ করতে চাইলে অন্তত ১০ দিন আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হচ্ছে। একইভাবে বিদেশিরা মিয়ানমার ছাড়ার ১০-১৫ দিন আগে সরকারের অনুমতি নিয়ে যেতে পারবেন। অর্থাৎ, মিয়ানমারের প্রবেশ কিংবা দেশটি থেকে বের হওয়া, দুই ক্ষেত্রেই সরকারের অনুমতি বাধ্যতামূলক। এই নিয়ম বিদেশি কূটনীতিকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। চলাচলে এমন বিধিনিষেধের কারণে বিদেশিদের মিয়ানমার যাওয়া-আসা এক রকম বন্ধই হয়ে গেছে।
মিয়ানমারের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে তেল ও গ্যাস। এসব খাতে বিদেশি যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করত, মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চায়। শেভরন ও টোটালের যে ব্যবসা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, তার খুব ছোট একটি অংশ বিনিয়োগ ছিল মিয়ানমারে। তাই মানবাধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানগুলো মিয়ানমারের তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

গত এক বছরে টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত আছে। অতীতে ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে সরকারি লেনদেনের হারের সঙ্গে মিয়ানমারের মুদ্রা লেনদেনের খোলা বাজারের সঙ্গে দুই থেকে আড়াই গুণ তফাত থাকত। গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির উন্নতি হলেও, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর পরিস্থিতি আবার আগের দিকেই যাচ্ছে। এক বছর আগে ১ হাজার ৩০০ চাট ছিল এক ডলারের বিনিময় মূল্য। সরকারি হিসাবে এখন ডলারের বিনিময়ে ১ হাজার ৭৮০ চাট। আর খোলা বাজারে এক ডলার সমান ২ হাজার ১০০ চাট। এর ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। ব্যাংকের তারল্য সংকট লোকজনকে ভোগাচ্ছে। এমনকি মাসের পর মাস লোকজন ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলতে পারছেন না। দেশটির সমাজ এখন পর্যন্ত কৃষিভিত্তিক বলে অর্থনীতিতে কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা রয়েছে। কৃষিঋণ না পাওয়ায় কৃষকেরা গত বছর পর্যাপ্ত উৎপাদনে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, সাধারণত মে থেকে জুলাই মাসে চালের বড় উৎপাদনটা হয়।

আমদানি-রপ্তানি সংকটের উল্লেখ করে মিয়ানমারে ব্যবসা করেন এমন বেশ কয়েকজন জানালেন, বিদেশে কনটেইনারে পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা জানান, এক বছর আগে ইউরোপে এক কনটেইনার মাছ পাঠাতে গড়ে দুই হাজার ডলার ভাড়া দিতে হতো। এখন তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২০ হাজার ডলার। আবার সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় বেশ কয়েকটি কারখানায় আগুন লাগার পর অনেক তৈরি পোশাক কারখানা তাদের অর্ডার বাতিল করেছে। কিছু কিছু অর্ডার বাংলাদেশে চলে গেছে। ফলে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে মিয়ানমারে যে অগ্রগতি শুরু হয়েছিল, সেটি থমকে গেছে। মিয়ানমারে ব্যাপক হারে কনডোমিনিয়াম নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। সেখানে চীন ও ভিয়েতনামের বিনিয়োগ যেমন ছিল, তেমনি মাদক, মূল্যবান পাথর বিক্রির অবৈধ আয়ে জড়িত সেনা কর্মকর্তারাও বিনিয়োগ করেছিলেন। গত এক বছরে এসব নির্মাণকাজও বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে মিয়ানমারের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী লোকজনের সংখ্যা ৫০ ভাগ ছাড়িয়ে যাবে। সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের আগে এই হার ছিল ১৭।

বেশ কয়েক বছর ধরেই মিয়ানমার নিয়ে গবেষণা করছেন রিচার্ড হোর্সে। গত সপ্তাহে রিচার্ড হোর্সে তাঁর এক বিশ্লেষণে লিখেছেন, সামনের দিনগুলোতে এক ধরনের টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই যাবে মিয়ানমার। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারী গোষ্ঠীগুলো তাদের লক্ষ্যে হামলা পরিচালনার ক্ষেত্রেও ক্রমেই পারদর্শী হয়ে উঠছে। বিশেষ করে নৃতাত্ত্বিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাদের আঁতাত জোরদার হচ্ছে। এসব গোষ্ঠীর অনেকের সামরিক সক্ষমতা উল্লেখ করার মতো।

সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দিতে তাদের এ তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও, পাল্টা হামলার জন্য তৈরি থাকবে সেনাবাহিনী। দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে মিয়ানমারে একটি দীর্ঘমেয়াদি ভয়াবহ লড়াই অত্যাসন্ন হয়ে পড়েছে; অর্থাৎ সেনাবাহিনীর স্থানীয় ইউনিট, প্রতিরোধ বাহিনীর সদস্য, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী—এমনকি অপরাধী গোষ্ঠীসহ নানান স্থানীয় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকবে দেশের বড় একটি অংশ। এমন এক পরিস্থিতির মাঝখানে থেকে মিয়ানমারের জনগণকে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।