যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস। কিশোর বয়সে লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টির সমর্থক ট্রাস কীভাবে কনজারভেটিভ পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বে উঠে এলেন, সেদিকে আলোকপাত করেছে বিবিসি ও সিএনএন।
আশির দশকে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের বিরুদ্ধে রাজপথে নামা লিজ ট্রাস এখন নিজেকে থ্যাচারের আদর্শের মশালের একজন ধারক হিসেবে পরিচয় দেন। প্রথমে ব্রেক্সিটের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। পরে নাটকীয়ভাবে এর পক্ষে অবস্থান নেন লিজ ট্রাস, যা রাজনীতিতে তাঁর উত্থানে বিরাট ভূমিকা রাখে।
রাজনীতিতে লিজ ট্রাসের যাত্রা অনেকের কাছে গুরুত্বহীন মনে হতে পারে। তাঁর জন্ম ১৯৭৫ সালে। তিনি যুক্তরাজ্যের এমন একটা অংশ বেড়ে উঠেছেন, যেখানে কনজারভেটিভ পার্টিকে ভোট দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না। স্কটল্যান্ড ও উত্তর ইংল্যান্ডেই ঘুরেফিরে তিনি থেকেছেন।
লিজ ট্রাস লিডসের একটি সরকারি স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। ছাত্র থাকাকালে তিনি লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। দলটি দীর্ঘদিন ধরে ইংল্যান্ডের বেশির ভাগ অঞ্চলে কনজারভেটিভ পার্টির বিরোধী দলের ভূমিকায় রয়েছে।
লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টির সদস্য থাকা অবস্থায় গাঁজা সেবনের বৈধতা এবং ব্রিটিশ রাজতন্ত্র বিলোপের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন লিজ ট্রাস; যা তাঁর বর্তমান অবস্থানের পুরোপুরি বিপরীত।
লিজ ট্রাসের ভাষ্যমতে, ১৯৯৬ সালে তিনি কনজারভেটিভ পার্টিতে যোগ দেন। এর মাত্র দুই বছর আগে লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টির এক সভায় বক্তব্যে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের অবসানের দাবি তুলেছিলেন তিনি।
কনজারভেটিভ পার্টিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই লিজ ট্রাসের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন লিবারেল ডেমোক্র্যাটস দলের সাবেক সহকর্মীরা। এখন পর্যন্ত লিজ ট্রাসকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিত্রায়িত করেন করেন তাঁরা।
লিজ ট্রাসের এক সময়ের সহকর্মী ও লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টির কাউন্সিলর নীল ফ্যাকেট ৯০-এর দশকে একসঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, লিজ ট্রাস পেছনে বসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। মাদকের অনুমোদন ও রাজতন্ত্র বিলোপের দাবি এরই অংশ ছিল।’
লিজ ট্রাস সব সময় আশপাশের মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইতেন। কনজারভেটিভ পার্টিতে যোগ দিয়ে এমপি হওয়ার পর থেকে তিনি প্রায় প্রতিটি রক্ষণশীল মতকে জোরালো সমর্থন দিয়েছেন। তিনজন প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভায় আস্থাভাজন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তাঁর এই আস্থাশীলতার সর্বশেষ নিদর্শন হলো বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে ছেড়ে না গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়া।
লিজ ট্রাসের রাজনৈতিক জীবনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বের হওয়া নিয়ে যখন আলোচনা তুঙ্গে, ঠিক ওই সময়ই তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে অবস্থান নেন। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তিনি বেশ সরব হয়ে ওঠেন। তখন টুইটবার্তায় লিজ ট্রাস লেখেন, যাঁরা ইউরোপী ইউনিয়নে থাকতে চান তাঁদের সমর্থন করেন তিনি। এর কারণ হিসেবে বলেন, এটা যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির জন্য খুব প্রয়োজন। এর মানে হলো, যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ও সামাজিক সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখন গুরুত্বারোপ করা সম্ভব হবে।
এরপর ওই বছর গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় আসার পর ভোল পাল্টে ফেলেন লিজ ট্রাস। রাতারাতি নিজের এই অবস্থান পরিবর্তনের পক্ষে যুক্তিও দেন তিনি। বলেন, ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন হলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে বলে তিনি ধারণা করতেন, যেটি ভুল ছিল।
ব্রেক্সিট ইস্যুতে লিজ ট্রাসের অবস্থান কতটা স্বাভাবিক ছিলো তা নিয়ে কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যেই বিতর্ক আছে। অনেকেই মনে করেন, ২০১৬ সালে ব্রেক্সিট ইস্যুতে গণভোট আয়োজনের সময় সরকারি আদেশ পালন করেছিলেন তিনি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন করেছিলেন গেভিন বারওয়েল। তিনি বলেন, ‘ব্রেক্সিট নিয়ে ভোটাভুটির পর ট্রাস খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, এখানে তখন সমঝোতার কিছু নেই। যদি আপনাকে ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করতে হয় তাহলে সেটি পুরোপুরি করতে হবে।’
লিজ ট্রাস যত বেশি ক্ষমতার কাছাকাছি আসছিলেন, যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের মধ্যে তত বেশি আগ্রহ তৈরি হচ্ছিল যে তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে কেমন হবে। কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রচারে দলের অ্যাজেন্ডাগুলোকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হলে দায়িত্ব পাওয়ার প্রথম দিন থেকেই কর কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন লিজ ট্রাস। পাশাপাশি করপোরেশন কর কমানোর মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেন। জ্বালানিসংকটের মধ্যে জ্বালানি কোম্পানিগুলো বিপুল পরিমাণ ব্যবসা করার পরেও তাদের ওপর বড় ধরনের কর আরোপ করা হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি।
এসব কারণে অনেকেই মনে করছেন, লিজ ট্রাস প্রধানমন্ত্রী হলে বরিস জনসনের মতোই তাঁর কর্মকাণ্ড হতে পারে। কর কমানোর ওপর লিজ ট্রাস অনেক বেশি জোর দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ইউরোপের বিষয়েও তার অবস্থান খুব কঠোর। সমালোচকেরা মনে করছেন, কর কমানোর প্রতিশ্রুতি মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়াতে পারে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাসের মধ্যে এ ধরনের সিদ্ধান্তের ফলে সুদের হারও বাড়তে পারে।