সাদিয়া বদছি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ ৬ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। সেদিনের রাতটি যেন দুঃস্বপ্ন হয়ে এসেছিল তাঁর জীবনে।
মরক্কোর মারাকেশ শহরের বাসিন্দা সাদিয়া। ভূমিকম্পে ছাদ ধসে বাড়িতে আটকা পড়েন তিনি। কোনোভাবেই সেখান থেকে বের হতে পারছিলেন না। এমন অবস্থায় তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন প্রতিবেশীরা। তাঁদের সহায়তায় শেষ পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপ থেকে নিরাপদে বের হন তিনি।
ভয়াল সেই রাতের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সাদিয়া বলেন, ‘ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে প্রতিবেশীরা আমাকে বাঁচিয়েছিলেন। ভূমিকম্পে আমার বাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই প্রতিবেশীদের বাড়িতেই এখন থাকতে হচ্ছে।’
গত শুক্রবার মরক্কোতে মধ্যরাতের ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা তিন হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। আহত হয়েছেন দুই হাজারের বেশি মানুষ। শক্তিশালী এই ভূমিকম্পে মারাকেশের বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে শহরটি প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
ভূমিকম্পে মারাকেশসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগস্ত এলাকার বাসিন্দারা ঘরবাড়ি হারিয়ে খোলা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। পরাঘাতের ভয়ে অনেকেই খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন।
মারাকাশের আরেক বাসিন্দা খাদিজা সাতুর কাছে প্রথম মনে হয়েছিল, তাঁর কক্ষটি ঘুরছে। এমন পরিস্থিতিতে কী হয়েছে, বুঝে ওঠার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি তখন মাত্রই ঘুমানোর জন্য বিছানায় গেছি। তখন মনে হচ্ছিল সবকিছু যেন কাঁপছে।’
খাদিজা সাতু আরও বলেন, ‘প্রথম ভেবেছিলাম বাইরে কোথাও বোধ হয় আগুন লেগেছে, নয়তো কোনো নির্মাণকাজ চলছে। কিন্তু কাঁপুনিটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। একপর্যায়ে আমার কাছে মনে হলো, কক্ষটা যেন ঘুরছে। এমন অবস্থায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। এখন হয়তো এটা নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু তখনকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ ছিল। একসময় মানুষের চিৎকার টের পেলাম। তখন বুঝতে পারি, এটা ভূমিকম্প।’
বিপদ আঁচ করতে পেরে দ্রুত অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হন খাদিজা। মুঠোফোন ফেলে খালি পায়ে বাসা ছাড়েন তিনি। বের হওয়ার সময় ভবনের সিঁড়িগুলোও যেন দুলছিল। তিনি বলেন, ‘ওই সময় মনে হয়েছে, এখান থেকে কোনো কিছু সঙ্গে নিয়ে বের হওয়া সম্ভব নয়। ভূমিকম্প খুবই অল্প সময় ছিল, কিন্তু এর প্রভাব অনন্তকাল ধরে থাকবে। লোকজন আতঙ্কে কান্নাকাটি করছিল, একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরছিল।’
ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠের ২৬ কিলোমিটার গভীরে। কম গভীর হওয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। ১৯৬০ সালের পর এটি মরক্কোর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্প। এতে দেশটির পার্বত্য এলাকায় প্রাণহানি বেশি হয়েছে। মরক্কোর বিখ্যাত কুতুবিয়া মসজিদ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত এই মসজিদের ক্ষয়ক্ষয়তির পরিমাণ প্রাথমিকভাবে জানা যায়নি।
ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছেই পার্বত্য গ্রাম তাফিগাগতি। এখানে ঐতিহ্যবাহী ইট দিয়ে তৈরি অসংখ্য ভবন ভেঙে পড়েছে। স্থানীয় যাযাবর সম্প্রদায়ের লোকজন এসব বাড়ি তৈরি করেছিল।
এটলাস পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত আমিজমিজ গ্রাম। মারাক্কাশ থেকে ৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণে গ্রামটির অবস্থান। রোববার সেখানে খালি হাতে ধ্বংসস্তূপ সরাতে দেখা গেছে উদ্ধারকর্মীদের। সেখানকার এক বাসিন্দা বলেন, গ্রামের সবার বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। সবাই ভূমিকম্পে প্রিয়জন হারানোর শোকে কাতর।
আমিজমিজের আরেক বাসিন্দা বলেন, গ্রামে বিদ্যুৎ, খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের স্বল্পতা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সংকটের মধ্যে বেঁচে আছি। এই অবস্থায় রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। তিনি যেন আমাদের জন্য সাহায্য পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।’
মারকাশের বাসিন্দা খাদিজা সাতু বলেন, ওল্ড সিটিতে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়ি একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাঁর এক সহকর্মীর বাড়ি এটলাস পর্বতমালার পাদদেশের এক গ্রামে। ভূমিকম্পের পর তিনি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছেন।
খাদিজা আরও বলেন, ‘পরাঘাতের ভয়ে রাতে আমরা বাগানে ঘুমিয়েছি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। আমি বাড়ি যেতে পারছি না। রাস্তায় থাকাটা কিছুটা বিদঘুটে অনভূতি। কারণ, এই শহরের হাসি-কান্না আমি দেখেছি। কিন্তু এবারের বেদনার ধরন অবিশ্বাস্য। মানুষ রাস্তায় রাত-দিন পার কাটাচ্ছে। কারণ, তারা বাড়ি ফিরতে ভয় পাচ্ছে।’