সুদানের রাজধানী খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ নিতে দুই পক্ষের মধ্যে সাত সপ্তাহের লড়াইয়ে এক নতুন সমস্যার মুখোমুখি রাজধানীবাসী। আগে কখনো তারা এমন সমস্যার মুখে পড়েনি। রাস্তাঘাটে চারপাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে মরদেহ। বাতাসে পচা গন্ধে ভারী হয়ে উঠছে রাজধানীর পরিবেশ।
ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে গত ১৫ এপ্রিল থেকে সুদানে সংঘাত চলছে। এক পক্ষে রয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান। অন্য পক্ষে আছেন আরএসএফের প্রধান সাবেক মিলিশিয়া নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো ওরফে হেমেদতি। এই দুই জেনারেল সম্মিলিতভাবে ২০২১ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সুদানের ক্ষমতা দখল করেছিলেন।
কিন্তু আরএসএফকে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একীভূত করা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে। আরএসএফকে সামরিক বাহিনীতে একীভূত করার সময় কে সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হবেন, সেই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে তাদের মধ্যে লড়াই শুরু হয়।
এই লড়াইয়ে ঠিক কতজন মারা গেছেন, তা নিশ্চিত না হলেও ধারণা করা হচ্ছে, এই লড়াইয়ে বেসামরিক মানুষসহ হাজারের বেশি মানুষ এরই মধ্যে নিহত হয়েছে। গৃহহীন হয়েছেন ১০ লাখের বেশি মানুষ। প্রাণভয়ে অসংখ্য মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
ওমর (ছদ্মনাম) নামের এক ব্যক্তি বিবিসিকে বলেন, ‘আমি নিহত তিন ব্যক্তির মরদেহ তাদের ঘরের ভেতরে দাফন করেছি। আর বাকিদের রাস্তার মাথার পাশেই দাফন করেছি। সেখানেই আমি থাকি।’ তিনি বলেন, ‘আমি ঘরের দরজা খুলেই কুকুর মানুষের মরদেহ চিবিয়ে খাচ্ছে, এমন দৃশ্য দেখার চেয়ে এভাবে দাফন করাও ঢের ভালো।’
লড়াইরত দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক দফায় যুদ্ধবিরতি হলেও তারা তা মানে না। এই অবস্থায় মরদেহ কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক। ওমর দাবি করেন, তিনি অন্তত ২০ জনকে দাফন করেছেন।
ওমর বিবিসিকে বলেন, ‘আমার এক প্রতিবেশীকে তাঁর বাড়িতে মারা হয়েছে। আমি কিছু করতে পারিনি। পরে তার ঘরের মেঝের টাইলস তুলে গর্ত খুঁড়ে তাঁকে কবর দিয়েছি। গরমে মরদেহগুলো পচে যাচ্ছে। আমি কী বলব? খার্তুমের কিছু কিছু এলাকা এখন কবরস্থানে পরিণত হয়েছে।’
গত মাসে ওমর খার্তুমের আল–ইমতিদাদ জেলায় তাঁর বাড়ি থেকে কয়েক মিটার দূরে রাস্তার পাশে চারজনের জন্য কবর খুঁড়েছেন। শুধু যে তিনি এমনটা করছেন তা নয়, তাঁর মতো অনেকেই এই কাজ করছেন।
ওমর বলেন, যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের অনেকের মরদেহ খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছের এলাকাগুলোতে কবর দেওয়া হয়েছে। অন্য মরদেহগুলোকে মোহাম্মদ নাগুইব সড়কের কাছাকাছি এলাকায় দাফন করা হয়েছে।
কতজনকে বাড়িতে বা সুদানের পার্শ্ববর্তী এলাকায় কবর দেওয়া হয়েছে, তার কোনো সরকারি হিসাব নেই। কিন্তু ওমরের ভাষ্য, ‘এ সংখ্যা কয়েক ডজন হবে।’
হামিদ (ছদ্মনাম) নামের আরেকজনেরও একই অভিজ্ঞতা। হামিদ বিবিসিকে বলেন, একটি সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার পর তিনি রাজধানী থেকে ১২ কিলোমিটার বাইরে শামবাত শহরের একটি এলাকায় তিন সেনাসদস্যকে কবর দিয়েছেন।
হামিদ বলেন, ‘ঘটনাক্রমে আমি সেই এলাকায় ছিলাম। আমিসহ ছয়জন আমরা ধ্বংসস্তূপ থেকে সেনাসদস্যদের বের করি আনি। এবং চারদিকে আবাসিক ভবন রয়েছে, এমন একটি জায়গায় তাদের দাফন করি।’
২০ বছর ধরে ওই এলাকায় বসবাসকারী হামিদ মনে করেন, এটি একটি ‘মানবিক কাজ’। তিনি বলেন, ‘এটা জরুরি নয়, তাদের কোথায় কবর দিচ্ছি। তাদের কবর দেওয়াটি বেশি জরুরি। এটি একটি দাতব্য কাজ। তাদের কবরস্থানে নিতে গেলে কয়েক দিনও লেগে যেতে পারত। আর চারদিকে হামলাকারীরা লুকিয়ে আছে। আমরা সমাজকে স্বাস্থ্য বিপর্যয় এড়াতে সাহায্য করার চেষ্টা করছি। এটি একটি ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব।’
সৎ উদ্দেশ্য থাকার পরও এই উদ্যোগ অজান্তেই যুদ্ধাপরাধের প্রমাণগুলোকে নষ্ট করে দিতে পারে বলে মনে করছেন চিকিৎসকদের ইউনিয়নের প্রধান ডাক্তার আতিয়া আবদুল্লাহ আতিয়া।
যেভাবে দাফন করা হচ্ছে, সেটা ‘অপেশাদার’ পদ্ধতি। এর মধ্য দিয়ে ‘সত্যের কবর’ হতে পারে বলে সতর্ক করেন আতিয়া। তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে লোকজনকে কীভাবে মারা হয়েছে, সেই সূত্রগুলোও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
চিকিৎসক আতিয়া বলেন, মৃতদেহগুলোকে শনাক্ত করে সময়মতো ও মর্যাদার সঙ্গে দাফন করা উচিত। তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের দাফনের প্রক্রিয়াটি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ, রেডক্রস এবং সুদানিজ রেড ক্রিসেন্টের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ওপর জোর দেন।
আতিয়া বলেন, ‘মরদেহ এভাবে দাফন করা ন্যায়সংগত নয়। দাফনের প্রক্রিয়ায় সরকারি প্রতিনিধি, আইনের লোক, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ এবং রেডক্রসের সদস্যদের উপস্থিত থাকা উচিত। আর মরদেহ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ।’
দুটি মরদেহ ১২ দিন পড়ে ছিল। আশপাশের লোকজন পচা গন্ধ আসছে বলে জানাচ্ছিল। তাই স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় বাগানে একটি কবরেই দুজনকে দাফন করা হয়েছে।
এমন একটি দেশ যেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, সেখানে এসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা কীভাবে সম্ভব, এমন প্রশ্নে আতিয়া বলেন, এ ক্ষেত্রে বিদেশিদের ভূমিকা পালন করা উচিত।
ওমর ও হামিদ নামের দুই স্বেচ্ছাসেবকই বলেছেন, দাফন করার আগে তাঁরা মরদেহের মুখ ও মরদেহের ছবি তুলে রাখছেন, যাতে ভবিষ্যতে শনাক্ত করা যায়। কিন্তু আতিয়া সতর্ক করে বলছেন, যেভাবে দাফন করা হচ্ছে, তাতে অসুখ–বিসুখ ছড়িয়ে পড়তে পারে। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, মৃতদেহগুলো এত অগভীর স্তরে দাফন করা হচ্ছে যে কুকুর বা অন্য কোনো হিংস্র প্রাণী খুব সহজেই সেগুলো তুলে ফেলতে পারবে। মরদেহ ঠিকমতো দাফন করা হচ্ছে না। সে জন্য কবরের ওপর ভারী কিছু বা ইট দেওয়া প্রয়োজন।
তবে হামিদ বলেন, সুদানের বেশির ভাগ মানুষই যাঁরা মরদেহ দাফন করছেন, তাঁরা ঠিকভাবে কবর খুঁড়ছেন। অন্তত মাটির এক মিটার গভীর পর্যন্ত খনন করছেন। কিছু কিছু মরদেহ নিয়ম মেনে দাফন করা হচ্ছে।
আহমদ নামের একজন রাস্তা থেকে মরদেহ সরাতে রেডক্রসের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, নিহত মানুষটির মুখের ও পুরো দেহের ছবি তুলে রাখছেন। নতুন মরদেহ বা পচে যাওয়া হলে নম্বর দিয়ে রেকর্ড রাখছেন। ভবিষ্যতে পরিচয় শনাক্ত করতে প্রতিটি মানুষের আলাদা ফাইল তৈরি করা হচ্ছে।
ডাক্তার আতিয়ার সমালোচনা থাকলেও লোকজন মনে করছেন, জনস্বাস্থ্য অবকাঠামো ভেঙে পড়ার কারণে তাঁদের কাছে অন্য কোনো বিকল্প নেই।
গত ১১ মে সুদানের দুই চিকিৎসক বোন মাগদোলিন ও মাগদা ইউসেফ ঘালিকে কবর দেওয়া হয় তাঁদের বাড়ির বাগানে। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁদের ভাই নাম না প্রকাশের শর্তে বিবিসির সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন। তিনি বলেন, দুই বোনকে সেখানে কবর দেওয়াই ছিল ‘একমাত্র সমাধান’।
অশ্রুসিক্ত অবস্থায় নিহত দুই বোনের ভাই বলেন, দুটি মরদেহ ১২ দিন পড়ে ছিল। আশপাশের লোকজন পচা গন্ধ আসছে বলে জানাচ্ছিল। তাই স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় বাগানে একটি কবরেই দুজনকে দাফন করা হয়েছে।
রেডক্রস ও সুদানিজ রেড ক্রিসেন্টের সঙ্গে মিলে মরদেহগুলো কবরস্থানে নিতে কাজ করছে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দুই পক্ষের চলমান লড়াই এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই ভাইবোনদের গল্প সেই ভয়াবহতাকে তুলে ধরেছে, যা সুদানের মানুষকে প্রতিদিন মুখোমুখি হতে হচ্ছে। দুই বোন হারানো এই ভাই বলেন, ‘আমার বোনদের এমন পরিণতি হবে, আমি কোনো দিন কল্পনাও করিনি।’