সুদানের রাজধানী খার্তুমসহ অন্যান্য শহরে চলছে সশস্ত্র লড়াই। এই লড়াইয়ে এক পক্ষে আছে দেশটির সেনাবাহিনী, অপর পক্ষে আছে সুদানের ক্ষমতাধর আধা সামরিক বাহিনী। দুই পক্ষের লড়াই মূলত ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে। এ লড়াইয়ের ফলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরুর ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করছেন সামরিক বিশ্লেষকেরা।
সুদানে হঠাৎ কেন এই লড়াই শুরু হয়েছে, তা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।
সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতাধর আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তেজনার পর ১৫ এপ্রিল লড়াই শুরু হয়।
বিবদমান দুই পক্ষই একসময় মিত্র ছিল। দুই পক্ষ মিলে ২০২১ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সুদানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।
কিন্তু আরএসএফকে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একীভূত করা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে।
মূল প্রশ্নটি হলো, নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকছে এবং আরএসএফকে সামরিক বাহিনীতে একীভূত করার সময়ে কে সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হবেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এটা হলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।
বেশির ভাগ লড়াই হচ্ছে রাজধানী খার্তুমে। তবে দেশজুড়ে সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে চার শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার।
সুদানে চলমান এই সহিংসতার প্রধান চরিত্র সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল–বুরহান এবং তাঁর সহকারী ও আরএসএফের প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো, সবার কাছে যিনি জেনারেল হেমেদতি নামে পরিচিত।
২০২১ সালের অক্টোবরে আল-বুরহান ও দাগালো একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন, যা দীর্ঘদিনের শাসক ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে অপসারণের পর শুরু হওয়া বেসামরিক সরকার গঠনের প্রক্রিয়াকে ভঙ্গুর করে তোলে। আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতা থেকে সরাতে তাঁরা দুজন একসঙ্গে কাজ করেছিলেন।
আল–বুরহানের জন্ম সুদানের উত্তরাঞ্চলে। ওমর আল–বশিরের প্রায় ৩০ বছরের শাসনামলে একজন সেনা কমান্ডার হিসেবে তাঁর উত্থান। অভ্যুত্থানের পর তিনিই কার্যত সুদানের ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন।
অপর দিকে দাগালোর জন্ম দারফুর অঞ্চলে। উট চরানো আরব গোত্রের সদস্য তিনি। অভ্যুত্থানের পর আল–বুরহানের পরের অবস্থানে অভিষিক্ত হন তিনি।
অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে শুরু হয় রাজনৈতিক সংকট। এ সংকট সমাধানে সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক নেতারা এক হয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর উপায় নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। আলোচনায় আরএসএফকে নিয়মিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করার বিষয়টি নিয়েই বিপত্তি বাধে সবচেয়ে বেশি।
সুদানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন খায়ের খোলুদ নামের একজন। এ বিশ্লেষক বলেন, গত ডিসেম্বরে চুক্তির যে কাঠামো দাঁড়ায়, তা নিয়ে আল–বুরহান ও দাগালোর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ওই চুক্তিতে আল–বুরহানের সহকারীর বদলে দাগালোর অবস্থান তাঁর সমান করার কথা বলা হয়।
খার্তুমভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক প্রতিষ্ঠান কনফ্লুয়েন্স অ্যাডভাইজরির প্রতিষ্ঠাতা খায়ের খোলুদ আরও বলেন, ‘ক্ষমতার এই পরিবর্তনের কারণেই নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কার এবং আরএসএফের একীভূত করা নিয়ে আলোচনা টেবিলে উত্তপ্ত বিতর্কের বদলে এই বিভেদ শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নিয়েছে।’
আরএসএফ গঠন করা হয় ২০১৩ সালে। কথিত জানজাওয়িদ মিলিশিয়া গ্রুপের সদস্যদের নিয়েই এই আধা সামরিক বাহিনী গঠন করা হয়। দারফুর অঞ্চলে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত এই জানজাওয়িদ মিলিশিয়া গ্রুপ।
২০০০–এর দশকে দারফুর সংঘাতের সময় ওমর আল–বশির সরকার বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য এই মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে।
২০১৭ সালে ওমর আল-বশির এই গোষ্ঠীকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি আধা সামরিক বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে একটি আইন পাস করেন। এই আইনের ফলে আরএসএফ একটি স্বতন্ত্র বাহিনীর রূপ পায়।
মিডল ইস্ট কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক আদিল আব্দেল গাফার বলেন, ক্ষমতার দিক দিয়ে দ্রুত উত্থানের সঙ্গে ওমর আল–বশিরের মাধ্যমে দাগালোর ব্যবসায়িক অবস্থানও সংহত হতে থাকে। দাগালোর পরিবার স্বর্ণখনি, নির্মাণ খাত ও খামার ব্যবসা সম্প্রসারিত করে।
এই দাগালো পরে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ২০১৯ সালে সুদানে বিক্ষোভ শুরু হলে বশিরকে উৎখাতের পর সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন সরকারে তিনি উপপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সুদানের সঙ্গে লোহিত সাগর, সাহেল অঞ্চল ও হর্ন অব আফ্রিকার সীমান্ত আছে। এর কৌশলগত অবস্থান ও কৃষিজ সম্পদের কারণে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর নজর সুদানের দিকে। এতে করে দেশটিতে সফলভাবে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া জটিল হয়েছে।
সুদানের রাজনৈতিক উত্থান–পতন এবং সংঘাতের প্রভাব পড়ে ইথিওপিয়া, শাদ, দক্ষিণ সুদানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর।
সীমান্তে বিতর্কিত কৃষিজমি, ইথিওপিয়ার তাইগ্রে অঞ্চলের সংঘাত, যার কারণে হাজার হাজার শরণার্থী সুদানে আশ্রয় নিয়েছে এবং গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেঁনেসা বাঁধের কারণে ইথিওপিয়ার সঙ্গে সুদানের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।
ইয়েমেন যুদ্ধে সমর্থন দিয়ে আরএসএফ যখন দেশটিতে তাদের সেনা পাঠিয়েছিল, তখন এই মিলিশিয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো পরাশক্তিগুলো। এখন উভয় পক্ষকে সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে তারা।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের হর্ন অব আফ্রিকাবিষয়ক পরিচালক অ্যালান বোসওয়েলের ভাষ্য অনুযায়ী, সুদানে বর্তমানে যে সংঘাত চলছে, তা বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
কনফ্লুয়েন্স অ্যাডভাইজরির খায়েরের মতে, দুই জেনারেলই এখন ক্ষুব্ধ। তাঁরা রক্তের নেশায় মেতেছেন। এক পক্ষে বা উভয় পক্ষে ব্যাপক প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া কেউই যে আর আলোচনার টেবিলে বসবেন না, তা বেশ অনুমান করা যায়।
দুই জেনারেলই একে অপরের বিরুদ্ধে মারমুখী বক্তব্য–বিবৃতি দিচ্ছেন। খায়েরের মতে, ‘তাঁরা কেউই এখন নিজেদের এই অবস্থান থেকে সরে আসবেন না। সশস্ত্র এই সংঘাত-লড়াই যত দীর্ঘ হবে, তত বেশি ভোগান্তি বাড়বে সাধারণ মানুষের। একই সঙ্গে ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে কোনো জেনারেলই একক কর্তৃত্ব পাবেন না।’