২০০৯ সাল থেকে মধ্য আফ্রিকার দেশ গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আলী বঙ্গো। গত বুধবার সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন তিনি। এখন গৃহবন্দী। এ অভ্যুত্থান করেছে মূলত প্রেসিডেন্ট বঙ্গোরই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর বিশেষ শাখা রিপাবলিকান গার্ড।
অভ্যুত্থানের পরপরই প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ক্ষমতাচ্যুত আলী বঙ্গো ভেঙে পড়েছেন। তাঁর পক্ষে ‘আওয়াজ তোলার জন্য’ দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ দেশটিকে এক যুগের বেশি সময় শাসন করেছেন বঙ্গো। বিপুল বৈভব আর ঐশ্বর্য্যে দিন কাটিয়েছেন। তবে সেদিন তাঁকে দেখে অসহায় লাগছিল।
তথাকথিক পশ্চিমাবিরোধী মনোভাবের বিষয়টি নিয়ে ভাবা গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমার মনে হয়, প্রকৃত ঘটনাটা হচ্ছে দেশের বেশির ভাগ মানুষের কথা ভেবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিচালিত হয় না, এটা হয় মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থে। বহু বছর সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নতিই হয়নি।কোফি হফম্যান, ফেলো, আফ্রিকাবিষয়ক কর্মসূচি, চ্যাথাম হাউস
অবশ্য ক্ষমতাচ্যুত শাসকের আহ্বান যে সাধারণের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করেনি, তার প্রমাণ দেখা গেল গ্যাবনের রাজপথে। রাজধানী লিব্রেভিলসহ বিভিন্ন শহরে উল্লাস করছে সাধারণ জনতা। অনেকে সেনাদের সঙ্গে ছবি তুলছেন। ১৯৬৭ সালে বঙ্গোর বাবা ওমর আলীর রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার মধ্য দিয়ে পরিবারটির যে আধিপত্য চলছিল দেশটিতে, দৃশ্যত তার অবসান ঘটায় সেনাদের বাহবা দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
আফ্রিকার দেশগুলোতে একের পর এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটছে। এর বদলে উত্থান হচ্ছে নতুন নতুন সেনাশাসকের। ২০২০ সাল থেকে আফ্রিকায় ১০টি অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে। এসব অভ্যুত্থানের বেশির ভাগই হয়েছে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে।
কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে বরং গণতন্ত্রের এ পতনে উল্লাস করতে দেখা গেছে এসব দেশের মানুষকে। রাজপথে অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষ নিয়ে স্লোগান দিয়েছেন তাঁরা।
গ্যাবনের আগে আফ্রিকায় সর্বশেষ অভ্যুত্থানটি হয়েছে গত ২৬ জুলাই, নাইজারে। অভ্যুত্থানের পর দেশটির জেনারেলরা রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নেন। সেই সামরিক সরকারের সমর্থনে স্টেডিয়ামগুলো ছিল কানায় কানায় পূর্ণ।
এরও আগে ২০২১ সালে অভ্যুত্থান হয় গিনিতে। জনগণের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও ক্ষমতা আকড়ে রেখেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলফা কোন্দে। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করে সামরিক বাহিনী। গিনির সেই অভ্যুত্থানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল দেশটির জনতার বড় অংশ। সেনাদের ক্ষমতা দখল উদ্যাপন করেছিল তারা।
অগণতান্ত্রিক পন্থায় ও জোরপূর্বক রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেও আফ্রিকার মানুষ কেন এভাবে সমর্থন জানাচ্ছে, সেই প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফ্রিকায় বেসামরিক নেতৃত্ব নিয়ে সাধারণ মানুষ হতাশ। সামরিক নেতৃত্ব নিয়ে তাঁদের এ আশাবাদ সে হতাশারই প্রতিফলন।
লন্ডনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক চ্যাথাম হাউসের আফ্রিকাবিষয়ক কর্মসূচির সহযোগী ফেলো লীনা কোফি হফম্যান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, সামরিক বাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে জনগণের এ সমর্থন সরাসরি নয়। অর্থাৎ মানুষ সেনাবাহিনীকে সমর্থন নয়, বরং তারা ক্ষমতার পালাবদল চায়।
হফম্যান আরও বলেন, (সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের) এটা বলার সুযোগ হয়েছে, যে সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে, সেটি এমন এক সরকার, যারা জনগণের স্বার্থকে পুরোপুরি তুলে ধরে না।
গ্যাবন হলো আফ্রিকার সর্বশেষ দেশ, যেখানে ‘গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত’ নেতাকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করলেন সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। বঙ্গোর রিপাবলিকান গার্ডের প্রধান জেনারেল ওলিগুই এনগুয়েমার নেতৃত্বে একদল সেনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ঘোষণা করেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলেন আলী বঙ্গো।
গ্যাবনের জনসংখ্যা আনুমানিক ২৩ লাখ। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে আট লাখ নিবন্ধিত ভোটার। গত ২৬ আগস্ট দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোট গণনার সময় দেশটিতে কারফিউ জারি করা হয়েছিল। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ইন্টারনেট পরিষেবা। এ ছাড়া ভোটে আন্তর্জাতিক নির্বাচনী পর্যবেক্ষদেরও নিষিদ্ধ করেছিল বঙ্গোর সরকার।
অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নেওয়া জেনারেলরা বলছেন, বঙ্গোকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করার অন্যতম কারণ নির্বাচনে জালিয়াতি। শুধু গ্যাবন নয়, পুরো আফ্রিকার নির্বাচনী ব্যবস্থাই বিতর্কিত।
গ্যাবনে যেদিন অভ্যুত্থান হয়, সেদিনই আফ্রিকার আরেক দেশ জিম্বাবুয়ের নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এতে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট এমারসন এমনানগাগওয়া পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে দেশটির বিরোধী দলগুলো। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক নির্বাচনী পর্যবেক্ষকেরাও ওই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
সম্প্রতি আফ্রিকার আরেক দেশ নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বোলা তিনুবু। সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে অপসারিত নাইজারের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজোমকে ক্ষমতায় ফেরাতে আঞ্চলিক দেশগুলো যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বোলা তিনুবু। গ্যাবনে সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, এ অভ্যুত্থান এটাই তুলে ধরছে যে আফ্রিকা মহাদেশে ‘স্বৈরাচারের সংক্রমণ’ ঘটেছে। যদিও গত ফেব্রুয়ারিতে নাইজেরিয়ায় হওয়া জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ তুলেছিলেন বিরোধীরা। নির্বাচনে জালিয়াতি নিয়ে বিরোধী দলগুলো আদালত পর্যন্ত গিয়েছিল।
গত বছর আফ্রিকার দেশগুলোতে একটি জরিপ পরিচালনা করে আফ্রিকাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আফ্রোব্যারোমিটার। তাতে দেখা যায়, মহাদেশটির মাত্র ৪৪ শতাংশ মানুষ মনে করে, ভোট দেওয়ার মাধ্যমে নিজেদের অপছন্দের প্রার্থীকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করা যায়। চলতি বছর একই প্রতিষ্ঠানের করা আরেকটি জরিপে দেখা যায়, দেশটির মানুষের গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা কমছে। গত দশকে যেখানে ৭৩ শতাংশের গণতন্ত্রে আস্থা ছিল, এ বছর তা কমে হয়েছে ৬৮।
আফ্রিকার দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টরা সময় পেরোলে নির্বাচন দেন ঠিকই, যা নিতান্তই নিয়ম রক্ষার। গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট আলী বঙ্গো তার একটি উদাহরণমাত্র। উগান্ডা, রুয়ান্ডা, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি ও ক্যামেরুনের মতো দেশগুলোর প্রেসিডেন্টরাও অন্তত দুই দশক ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জীবনমানের দ্রুত অবনমন হওয়ায় গণতন্ত্রের সুফল সম্পর্কে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন তুলছেন আফ্রিকার মানুষ।
ক্রমাগত নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় আফ্রিকার জনজীবনে চরম দুর্দশা দেখা দিয়েছে। এতে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনাও বাড়ছে। বাড়ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। বিশ্ব্যব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ বছরের শেষ নাগাদ আফ্রিকার অর্থনীতির আকার তো বাড়বেই না, বরং ৩ দশমিক ১ শতাংশ কমবে। এর আগে গত বছর এ হার ছিল ৩ দশমিক ৬।
অর্থনীতির সামগ্রিক এমন দুরবস্থার কারণে বেসামরিক নেতৃত্বের ওপর জনগণের সমর্থন প্রতিনিয়ত কমছে। যদিও এসব নেতা ‘গণতান্ত্রিক’ উপায়ে নির্বাচিত এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তাঁদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
জনগণের মধ্যে সরকার পরিবর্তনের এমন আকাঙ্ক্ষার নেপথ্যে আরও একটি কারণ আছে। সেটি হলো বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকা।
গত পাঁচ বছরে আফ্রিকার যেসব দেশে সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে, সুদান বাদে বাকি সব দেশই একসময় ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। এসব দেশের সরকারের ওপর প্রভাব, কর্তৃত্ববাদী শাসকদের পক্ষ নেওয়া ও তাদের প্রতি সমর্থন জুগিয়ে যাওয়ায় ফ্রান্সকে দায়ী করে থাকে সাধারণ মানুষ।
জনগণের ফ্রান্সবিরোধী এ মনোভাব কাজে লাগাচ্ছেন অভ্যুত্থানকারী জেনারেলরা। তাঁরা ফ্রান্সবিরোধী বক্তব্য দিয়ে জনগণকে কাছে টানার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ফ্রান্স নিজের স্বার্থেই যে এসব কর্তৃত্ববাদী শাসককে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল, জনগণের মধ্যে সে বিষয়টি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে।
তবে আফ্রিকার দেশগুলোতে কর্তৃত্ববাদী সরকার ও তাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে বিদেশি বিভিন্ন শক্তির সমর্থনের বিপরীতে জেনারেলদের বিকল্প ভাবা নিয়ে সতর্ক করলেন কোফি হফম্যান।
চ্যাথাম হাউসের আফ্রিকাবিষয়ক কর্মসূচির ফেলো হফম্যান বলেন, ‘তথাকথিক পশ্চিমাবিরোধী মনোভাবের বিষয়টি নিয়ে ভাবা গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমার মনে হয়, প্রকৃত ঘটনাটা হচ্ছে দেশের বেশির ভাগ মানুষের কথা ভেবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিচালিত হয় না, এটা হয় মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থে। বহু বছর সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নতিই হয়নি।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আফ্রিকার মানুষ যে সেনা অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানাচ্ছেন, তার অন্যতম কারণ সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার না থাকা ও এর সুফল না পাওয়া। তবে তাঁরা এ-ও বলছেন, সুন্দর ভবিষ্যতের যে আশায় সাধারণ মানুষ সামরিক সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে, সেই সরকারও তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজে আসবে না। কারণ, জনগণের সুফল নয়, জেনারেলদেরও লক্ষ্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নেওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অ্যাটলাস নেটওয়ার্কের সেন্টার ফর আফ্রিকান প্রসপারিটির ফেলো ইব্রাহিম আনোবা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা অনেকটা ঘা হওয়ার মতো। ঘা চুলকালে ক্ষণিকের জন্য আরাম পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু চুলকানোর কারণে এর অবস্থা হয় আরও খারাপ। ঠিক এই চুলকানির মতো সাময়িক স্বস্তি হয়ে আসছে সামরিক বাহিনী।’
ভাষান্তর: আল-আমিন সজীব