ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধের ডামাডোলে আফ্রিকার দেশ সুদানে যে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছে, তা বিশ্ববাসীর চোখের আড়ালে রয়ে যাচ্ছে। এ গৃহযুদ্ধ বিশ্বের ‘ভয়াবহতম মানবিক পরিস্থিতি’ সৃষ্টি করেছে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশটিতে সাড়ে সাত লাখের বেশি মানুষ পড়তে পারে ‘বিপর্যয়কর খাদ্যসংকটে’।
গত বছরের ১৫ এপ্রিল থেকে আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহানের নেতৃত্বে সুদানের সশস্ত্র বাহিনী (এসএএফ) এবং জেনারেল মোহাম্মদ হামদান হেমেদতি দাগালোর অনুসারী আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে ভয়াবহ লড়াই চলছে। গত এক মাসের বেশি সময় ধরে উত্তর দারফুরের আল-ফাশের শহর অবরুদ্ধ করে রেখেছে আরএসএফ। আগে দুই বাহিনী পাশাপাশি থেকে সুদানের সরকারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করত।
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক বছরে সুদানে গৃহযুদ্ধে অন্তত ১৪ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এক কোটির বেশি মানুষ।
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত এ গৃহযুদ্ধে অন্তত ১৪ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এক কোটির বেশি মানুষ।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ গতকাল শুক্রবার আরএসএফকে ওই শহর থেকে অবরোধ তুলে নিতে বলে। তবে তাতে কর্ণপাত না করে সেখানে বড় ধরনের আক্রমণ চালিয়েছে আরএসএফ। তবে তা প্রতিহত ও প্রতিপক্ষের বড় ক্ষতি করার দাবি করেছে সুদানের সশস্ত্র বাহিনী।
এসএএফ এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, ব্যর্থ আক্রমণে আরএসএফের শতাধিক সদস্য হতাহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আলী ইয়াগুব গিবরিল নামে বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ কমান্ডারও রয়েছেন। কার্যত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেছেন এ বাহিনীর যোদ্ধারা।
অবশ্য আরএসএফের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনো কিছু জানানো হয়নি।
দাতব্য সংস্থা এমএসএফ বলেছে, গতকালের লড়াইয়ে আল-ফাশেরে অন্তত ২২৬ জন নিহত ও ১ হাজার ৪১৮ জন আহত হয়েছেন।
জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের আশঙ্কা, আরএসএফ আল-ফাশের শহরের দখল নিতে পারলে সেখানে জাতিগত নিধন চালাবে। শহরটিতে প্রায় ১৮ লাখ মানুষের বসবাস। দারফুর অঞ্চলে এটাই এখন সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর সবশেষ শক্ত ঘাঁটি।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সবশেষ প্রস্তাবে সুদানে দ্রুত যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা, বাধাহীনভাবে মানবিক ত্রাণসহায়তা প্রবেশের সুযোগ দেওয়া ও সব পক্ষকে সুদানের ওপর আরোপ করা অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়। পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে গত বছরের মার্চে দেশটিতে যুদ্ধবিরতি ডাকা হলেও তা ব্যর্থ হয়।
এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র গতকাল সুদানে জরুরি মানবিক সহায়তায় সাড়ে ৩১ কোটি মার্কিন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সেই সঙ্গে সতর্ক করে বলেছে, দেশটি দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে।
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস গ্রিনফিল্ড সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের চোখের সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে চলেছে, বিশ্বের এখন জেগে ওঠা প্রয়োজন।’
সুদানে সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ী লড়াই হচ্ছে দারফুর ও কোরদোফান অঞ্চলে। জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস গ্রিনফিল্ড আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে তীব্র খাদ্যসংকটে এ দুই অঞ্চলের প্রায় ২৫ লাখ মানুষ মৃত্যুর মুখে পড়তে পারে, যা জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ মানবিক সংকটে রূপ নিতে পারে।
সুদানের অনেক মানুষ আরএসএফের বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেশটির সামরিক বাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন। মুসা আদম তাঁদের একজন। দক্ষিণ দারফুরের এনইয়ালা শহরে তিনি বসবাস করতেন। যুদ্ধের কারণে তাঁকে বাড়িঘর ছাড়তে হয়েছে। আরএসএফ তাঁদের এলাকায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তার বর্ণনা দিয়ে আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, আরএসএফকে প্রতিহত করতেই সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন তিনি।
মুসা আদম বলেন, ‘মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তাদের মালামাল লুট করা হয়েছে, আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণ করা হয়েছে। সেই ক্ষোভ থেকে আমি সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দিয়েছি। আরএসএফ এনইয়ালার দখল নিয়েছে এবং সেখানে থাকা খুব বিপজ্জনক। তাই আমি চলে এসেছি।’
উত্তর দারফুরে ক্রমাগত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে আরএসএফ। প্রাণে বাঁচতে গত মাসে সেখান থেকে ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ অন্যত্র পালিয়ে গেছেন। সেখানে বেশ কয়েকটি গণকবর উদ্ধার হয়েছে বলে জানা গেছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু গ্রাম। গ্রামগুলোর বেশির ভাগ বাসিন্দা ছিলেন জাঘাওয়াস ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর।
সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন সাবেক আরএসএফ কর্মকর্তা আবু আল–কাসিম মোহাম্মদও। তিনি বলেন, ‘আমি গৃহযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিন থেকেই আরএসএফের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। কারণ, তারা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, দেশের বিরুদ্ধে লড়ছে।’