সুদানে গত শনিবার সামরিক বাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। দেশটির বেসামরিক শাসনে যাওয়ার ক্ষেত্রে যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, এই ঘটনা তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
দুই পক্ষের মধ্যে চলমান এই সহিংসতায় প্রায় ১০০ মানুষ নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশটির সামরিক বাহিনী এখন শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
সুদানের সেনাবাহিনীর প্রধানের দায়িত্বে আছেন জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান। তাঁর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী প্রতিপক্ষ আরএসএফের বিরুদ্ধে লড়ছে।
কয়েক বছর ধরে সুদান চালাচ্ছেন বুরহান। সুদানের কার্যত শাসক বুরহান কে, তা এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে আল-জাজিরা।
সুদানের দারফুর অঞ্চলে সংঘাত চলাকালে সেখানে দায়িত্ব পালন করেন বুরহান। ২০০৮ সাল নাগাদ তিনি আঞ্চলিক কমান্ডার হন। সুদানের সামরিক বাহিনীতে সক্রিয় ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও ২০১৯ সালের আগে তিনি পরিচিতি অর্জন করেননি।
দারফুরে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনায় সুদানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরসহ দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত।
দারফুরে দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও বুরহানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি। বুরহানের এক সময়ের মিত্র ছিলেন আরএসএফের বর্তমান প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো ওরফে হেমেদতি। তাঁর বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ নেই। এখন বুরহানের প্রতিপক্ষে হয়ে উঠেছেন হেমেদতি।
দারফুরে বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আরএসএফও কাজ করেছে। দারফুর সংঘাতে প্রায় ৩ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়, প্রায় ২৭ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। দারফুরে সংঘটিত নৃশংসতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন বুরহান।
গণবিক্ষোভ, অভ্যুত্থান, বেসামরিক শাসনে ফেরার প্রক্রিয়া লাইনচ্যুত
২০১৯ সাল নাগাদ বুরহান উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য জর্ডান ও মিসরে গিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর পদোন্নতি হয়। তিনি সুদানের সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ হন।
গণবিক্ষোভের জেরে ২০১৯ সালের এপ্রিলে সুদানের প্রেসিডেন্ট আল-বশিরকে উৎখাত করে দেশটির সেনাবাহিনী। এর মধ্য দিয়ে তাঁর প্রায় ৩০ বছরের একনায়ক শাসনের অবসান ঘটে। তখন বুরহান ছিলেন সেনাবাহিনীর মহাপরিদর্শক। সে সময় সুদানের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ জেনারেলদের মধ্যে তাঁর অবস্থান ছিল তৃতীয়।
দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো পরিচালনার জন্য গঠন করা হয় ট্রানজিশনাল মিলিটারি কাউন্সিল (টিএমসি)। একপর্যায়ে বুরহানকে টিএমসির প্রধান করা হয়।
মাস কয়েক পর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে টিএমসি বদলে গঠন করা হয় সার্বভৌম পর্ষদ (এসসি)। সামরিক-বেসামরিক অংশীদারত্বের ভিত্তিতে গঠিত এই পর্ষদ। এই পর্ষদ ২০১৯ সাল থেকে সুদান চালাচ্ছে।
সার্বভৌম পর্ষদ গঠনের পর তার প্রধান হন বুরহান। পর্ষদের উপনেতা আরএসএফের প্রধান হেমেদতি। সার্বভৌম পর্ষদের নেতা হিসেবে বুরহান কার্যত সুদানের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হন। এই পর্ষদ দেশটির গণতন্ত্রপন্থী বেসামরিক শক্তিগুলোর সঙ্গে কাজ করে আসছিল।
২০২১ সালে বুরহান ও হেমেদতি অভ্যুত্থান করে বসেন। তাঁরা সুদানের ক্ষমতা দখল করেন। এতে সুদানের গণতন্ত্রে ফেরার প্রক্রিয়া লাইনচ্যুত হয়।
সুদানের কার্যত রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বুরহান সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও মিসরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এই দেশগুলোই বশিরকে উৎখাতে সামরিক জেনারেলদের উৎসাহিত করেছিল।
একপর্যায়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে সামরিক বাহিনী ও আরএসএফ। এই দ্বন্দ্বের জেরে দুই পক্ষের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সুদানে সবশেষ যে সহিংসতার সূত্রপাত হলো, তা বুরহান ও হেমেদতি পক্ষের মধ্যকার ক্ষমতার লড়াইয়েরই বহিঃপ্রকাশ।