নাইজেরিয়ার লাগোসের সাঙ্গোতেদো শহরের বাসিন্দা চিওমা ওকোলি পেশায় ছোট ব্যবসায়ী। পাশাপাশি তিনি নিজের ব্যবসাসংক্রান্ত ফেসবুক পেজে বিভিন্ন পণ্যের রিভিউ করেন। ২০২৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর স্থানীয় একটি কোম্পানির তৈরি নাগিকো টমেটো পুরি (সস) নিয়ে তিনি একটি রিভিউ (পর্যালোচনা) করেছিলেন।
নাগিকো টমেটো পুরির রিভিউতে ওকোলি বলেন, ‘অন্য টমেটো পুরির চেয়ে এটি বেশি মিষ্টি বলে মনে হচ্ছে। আপনারা যাঁরা এটি খেয়েছেন, তাঁদের কার কেমন লেগেছে জানাবেন।’
ওকোলির কয়েক হাজার অনুসারীদের অনেকে পোস্টটি নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেন। কিন্তু এক ফেসবুক ব্যবহারকারীর মন্তব্যের কারণে পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যায়। ওই ব্যক্তি ওকোলির পোস্টে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমার ভাইয়ের পণ্য ধ্বংস করা বন্ধ করো। তুমি এটি পছন্দ না করলে তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা না বলে অন্য পণ্য ব্যবহার করো।’
এ মন্তব্যে ওকোলি পাল্টা মন্তব্য করেন, ‘এই পণ্যের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের হত্যা বন্ধ করা থেকে আপনার ভাইকে বিরত থাকার উপদেশ দিয়ে আমাকে দয়া করে সহায়তা করবেন।’
দুই দিন পর এই পোস্টে আড়াই হাজারের বেশি মন্তব্য আসে। এত অল্প সময়ে এত বেশি মন্তব্য আসায় কিছুটা বিস্মিত হন ওকোলি।
এসব পাল্টাপাল্টি মন্তব্যে ইতিমধ্যে এক সপ্তাহ পার হয়ে যায়। চলে আসে পরের রোববার, ২৪ সেপ্টেম্বর। এদিন যথারীতি প্রার্থনা সেরে নিজের স্বামীর সঙ্গে গির্জা থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন ওকোলি। এ সময় সাদাপোশাকে দুই পুরুষ ও এক নারী তাঁর দিকে এগিয়ে আসেন। তাঁরা নিজেদের পুলিশ কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেন। তাঁরা তাঁকে গির্জার পোশাকেই পার্শ্ববর্তী ওগুদু থানায় নিয়ে যান।
তিন সন্তানের মা ৩৯ বছর বয়সী ওকোলি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘তারা আমাকে একটি রুমে নিয়ে যায়। সেখানে আমি বসি। একটু পর তারা ২০ পৃষ্ঠার বেশি কাগজ নিয়ে এসে বলে, “এসব আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ।” আমি পোস্টটি সম্পর্কে ভুলেই গিয়েছিলাম। তাদের অভিযোগ শোনার পর আমার পোস্টের কথা মনে পড়ে। তারা আমার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও প্রতারণার (ব্ল্যাকমেইলিং) অভিযোগ আনে। তাদের অভিযোগ, আমি একটি সিন্ডিকেট পরিচালনা করি।’
নাইজেরিয়ায় ওকোলির মতো আরও অনেকে এমন সব অভিযোগে গত কয়েক বছরে আটক বা গ্রেপ্তার হয়েছেন। দেশটির সাইবার ক্রাইম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে তাঁদের আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অথচ আইনটি করা হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় তথ্যের সুরক্ষা দিতে, নাগরিকদের সাইবারস্টকিং বা অনলাইন হয়রানি থেকে বাঁচাতে।
কিন্তু আফ্রিকার এই দেশের অধিকার গোষ্ঠীগুলোর অভিযোগ, আইনটি সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, সরকারবিরোধী, এমনকি সাধারণ মানুষের বাক্স্বাধীনতা হরণ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
২০১৫ সালে সাইবার ক্রাইম আইনটি পাস করা হয় জানিয়ে নাইজেরিয়ার অধিকারকর্মী ও ওকিলোর আইনজীবী ইনিবেহে ইফিয়ং বলেন, অস্পষ্ট ভাষা ও বিস্তৃত আওতার কারণে আইনটি কর্তৃপক্ষ ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের অস্ত্রে পরিণত হয়। কোনো সাংবাদিক বা সরকারবিরোধী ব্যক্তি ক্ষমতাবানদের নিয়ে সত্য প্রকাশ করলে আইনটি তাঁদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ইকোনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটসের (ইকোওয়াস) আদালত ২০২২ সালে আইনটি সংশোধন করতে নাইজেরিয়াকে একটি রুলিং দেন। এতে বলা হয়, আইনটি আফ্রিকান চার্টার অন হিউম্যান অ্যান্ড পিপলস রাইটসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
এই রুলিংয়ের আলোকে গত ফেব্রুয়ারিতে আইনটি সংশোধন করেন নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট। এতে ২৪ নম্বর ধারার সংশোধন ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ ধারার মাধ্যমে সাইবারস্টকিংয়ের অভিযোগে সরকারবিরোধীদের টার্গেট করা হতো।
অধিকারকর্মী ইনিবেহে ইফিয়ং মনে করেন, নাইজেরীয় পুলিশ সাইবার আইনের সংশোধনী মেনে চলছে না।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নাইজেরিয়া গবেষক অ্যানিটি ইওয়াং বলেন, আইনটি সংশোধন করার পরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইনটিকে নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবহারের সুযোগ রয়ে গেছে। কারণ, সংশোধনীর ভাষাও অস্পষ্ট। কর্তৃপক্ষ এই অস্পষ্টতার সুযোগ নিচ্ছে।
গ্রেপ্তারের কয়েক দিন পর ওকোলিকে লাগোস থেকে রাজধানী আবুজায় পুলিশের সদর দপ্তরে নিয়ে আসা হয়। সেখানে কয়েক দিন আটকে রেখে তাঁকে জেরা করা হয়।
আবুজার পুলিশ সদর দপ্তরে নাগিকো টমেটো পুরি তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান এরিসকো ফুড লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এরিক উমিওফিয়াও এসেছিলেন। এক পুলিশ কর্মকর্তার কক্ষে ওকোলিকে উমিওফিয়ার সামনে আনা হয়েছিল। ওই কক্ষে ওকোলির সঙ্গে বেশ চিল্লাপাল্লা করেন উমিওফিয়া।
উমিওফিয়া চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘আমার ৪০ বছরে গড়ে তোলা ব্যবসা ধ্বংস করার পাঁয়তার করেছিলে তুমি। এ কাজ করার জন্য তোমাকে কেউ অর্থ দিয়েছে। তোমাকে সেই ব্যক্তির নাম বলতে হবে।’
ওকোলিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে বলেন উমিওফিয়া। তাঁর ফেসবুক ও তিনটি জাতীয় দৈনিকে ক্ষমা প্রার্থনার একটি বিবৃতি প্রকাশ করতে বলেন। কিন্তু এখানেই থামেনি নাগিকো টমেটো পুরি। প্রতিষ্ঠানটি ওকোলির বিরুদ্ধে ৩০ লাখ ডলারের বেশি ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করে।
ওকোলির দাবি, তিনি দুটি বিবৃতি খসড়া করে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিবারই তাঁরা তা বাতিল করে দেন। তাঁদের দাবি, তাঁকে কোম্পানির প্রস্তুত করে দেওয়া একটি স্বীকারোক্তি বিবৃতির হুবহু অনুলিপি তৈরি করতে হবে।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা বর্ণনা দিতে গিয়ে ওকোলি বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিল, ১০০ জন মানুষ ১ জনকে চেপে ধরেছে। একটি কাজ করতে আমাকে অবিরাম বলা হচ্ছে। তখন আমার কোনো আইনজীবীও ছিলেন না। তাই বাধ্য হয়ে আমি তাদের তৈরি করে দেওয়া স্বীকারোক্তি বিবৃতিটির অনুলিপি তৈরি করি। এরপর তারা তা গ্রহণ করে। তিন দিন পর আমি পুলিশের প্রধান কার্যালয় থেকে ছাড়া পাই।’
ঘটনার একপর্যায়ে ২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নাইজেরিয়ার খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (ন্যাফড্যাক) নাগিকো টমেটো পুরিতে চিনির মাত্রা মানুষের ব্যবহারের জন্য নিরাপদ বলে একটি বিবৃতি দেয়।
আর এরিসকো ফুড লিমিটেড এক বিবৃতিতে জানায়, ওকোলি তাদের কোম্পানির বিরুদ্ধে একটি ‘বিদ্বেষমূলক অভিযোগ’ এনেছে। তাই তারা কোম্পানির সুনাম ও খ্যাতি ফেরাতে সব ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেবে।
পুলিশ ইতিমধ্যে ওকোলির বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ এনেছে। এক. তিনি এরিসকো ফুড লিমিটেডের বিরুদ্ধে মানুষদের খেপিয়ে তুলেছেন। দুই. নিজের দাবি মিথ্যা জেনেও তিনি তা করেছেন।
মামলাটির বিষয়ে জানাজানি হওয়ার পর ওকোলির প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি বাড়তে থাকে। তাঁর মামলা পরিচালনার জন্য ‘গোফান্ডমি’ নামের একটি ক্যাম্পেইন পেজ তৈরি হয়েছিল। পুলিশ সেটিও বন্ধ করতে বলেছে।
ইতিমধ্যে ওকোলির আইনজীবী এরিসকো ফুডস লিমিটেড ও পুলিশের বিরুদ্ধে ৩ লাখ ৭৪ হাজার ১৭৫ ডলারের ক্ষতিপূরণ চেয়ে একটি মামলা করেন।
মামলার মারপ্যাঁচে পড়ে ওকোলি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর দুধের বাচ্চাকে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই দুধ ছাড়ানো হয়। কারণ, তাঁর শঙ্কা ছিল, তিনি যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারেন। গ্রেপ্তার হলে তাঁর দুধের শিশুকে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে। এরই মধ্যে শিশুদের জামাকাপড় বিক্রির ব্যবসার ফেসবুক পেজটিও হ্যাক হয়ে যায়।
একটি টমেটো পুরির রিভিউর পরবর্তী অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনকে বদলে দিয়েছে বলে জানান ওকোলি। তিনি বলেন, তাঁর এখন আগের মতো হাসিখুশি ভাব নেই। তিনি এখন বেশির ভাগ সময় ঘরে থাকতেই পছন্দ করেন। গির্জায় না গিয়ে অনলাইনে গির্জার কাজ সারেন।
সর্বশেষ গত ৯ জানুয়ারি পুলিশ ওকোলিকে আবার গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেছিল। অথচ তিনি জামিনে মুক্ত ছিলেন। পুলিশের অভিযোগ, তিনি আদালতে হাজিরা দেননি। তাঁরা ওকোলির ঘরের দরজার সামনে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত চলে যায়। কারণ, তিনি এ সময় সব দরজা-জানালা বন্ধ করেছিলেন এবং পুলিশকে বারবার বলছিলেন, তাঁর আইনজীবী না আসা পর্যন্ত তিনি তাঁদের দেখা দেবেন না।
ওকোলির মামলা নাইজেরিয়ার সাধারণ মানুষ ও অধিকার গোষ্ঠীর মধ্যে আলোড়ন তৈরি করেছে। সাইবার ক্রাইম আইনের অপব্যবহার করে যেভাবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, বাক্স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে, তাতে তাঁরা উদ্বিগ্ন। আইনটির কারণে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক সাংবাদিকও হয়রানির শিকার হয়েছেন।