লিবিয়ায় দুই পক্ষের প্রচণ্ড সংঘর্ষ

লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল সেরাজ এবং পূর্ব বাহিনীর প্রধান খলিফা হাফতার। ছবি: রয়টার্স
লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল সেরাজ এবং পূর্ব বাহিনীর প্রধান খলিফা হাফতার। ছবি: রয়টার্স

লিবিয়ায় জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিরোধী পক্ষ খলিফা হাফতার বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলোর আহ্বান উপেক্ষা করে সেখানে ভারী অস্ত্র নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের পর ত্রিপোলির সাবেক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কিছু শহরতলী দখলে নেওয়ার দাবি করেছে হাফতার বাহিনী।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকাল শুক্রবার লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের খলিফা হাফতারের বাহিনী জানিয়েছে, তারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লিবিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে রাজধানী ত্রিপোলির দক্ষিণাঞ্চলের শহরতলীতে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে। তারা ত্রিপোলির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

গতকাল ত্রিপোলির সাবেক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এলএনএ) গতকাল শেষ রাতের দিকে সেখানের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এলএনএ মুখপাত্র ও সেখানকার বাসিন্দারা এ তথ্য জানিয়েছে। তবে সরকার বাহিনী দাবি করেছে, সাবেক বিমানবন্দরটি তারা আবার নিজেদের দখলে নিয়েছে।

২০১১ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করে হত্যার পর দেশটির বাসিন্দারা সরকার ও সরকারের সমান্তরালভাবে চলা পূর্বভিত্তিক এলএনএ বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই দেখে আসছে।

ত্রিপোলির পশ্চিমাঞ্চলে গতকাল শুক্রবার হাফতার বাহিনীর সাঁজোয়া যান। ছবি: রয়টার্স

বেসামরিক যুদ্ধ এড়াতে হাফতারের সঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বৈঠক পণ্ড হওয়ার পরই এ সংর্ঘষের ঘটনা ঘটল। এ প্রসঙ্গে টুইটারে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছিলেন, ‘ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এবং গভীর উদ্বেগ নিয়ে আমি লিবিয়া ছেড়ে এসেছি। এখনো আমি আশাবাদী যে ত্রিপোলি ঘিরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব।’

শুক্রবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিল রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছে। বৈঠকের পর এপ্রিল মাসের জন্য কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টোফ হোয়েসগুন এক বিবৃতিতে এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কাউন্সিল এলএনএ বাহিনীকে সামরিক পদক্ষেপ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে। পাশাপাশি অন্য বাহিনীগুলোকেও সামরিক কর্মকাণ্ড বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে। সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে সংঘাতের কোনো সমাধান আসতে পারে না।

গুতেরেসকে হাফতার বলেছিলেন, সন্ত্রাসবাদ নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের অভিযান চলবে। সেই বিষয়টিকে তুলে ধরে আল অ্যারাবিয়া টিভি বলেছে, ৭৫ বছর বয়সী হাফতার নিজেকে ইসলামি চরমপন্থীদের বিরোধী বলে দাবি করেন। তবে বিরোধীরা তাঁকে গাদ্দাফির নতুন সংস্করণ বলে মনে করেন।

উপকূলীয় রাজধানী ত্রিপোলি হাফতারের পূর্বাঞ্চলের সমান্তরাল সরকারের জন্য পুরস্কার হিসেবেই হাজির হয়েছে। ২০১৪ সালে হাফতার গাদ্দাফির সাবেক সেনাদের একত্র করেন এবং তিন বছরের যুদ্ধে পূর্বাঞ্চলের মূল শহর বেনগাজি দখল করে নেন। এ বছর তিনি তেলসমৃদ্ধ দক্ষিণাঞ্চলও দখল করেছেন।

বিরোধ মিটমাট করে দেশটিতে জাতীয় পুনর্মিলনী সম্মেলন আয়োজনের লক্ষ্যে বেনগাজিতে হাফতারের সঙ্গে সাক্ষাতে পাশাপাশি গুতেরেস এই সপ্তাহে ত্রিপোলিও সফর করেন।

জাতিসংঘ সমর্থিত লিবিয়া সরকারের একজন পুলিশ সদস্যকে গতকাল শুক্রবার সামরিক যান গোছাতে দেখা যাচ্ছে। ছবি: রয়টার্স

গতকাল শুক্রবার এলএনএ জানিয়েছে, তারা রাজধানীর দক্ষিণাঞ্চলের শহরতলী কসর বেন ঘাশির এবং ওয়াদি আল-রাবি দখল করেছে। ২০১৪ সালের যুদ্ধের পর পরিত্যক্ত সাবেক ত্রিপোলি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও তারা দখল করছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের পাঁচজন সেনা নিহত হয়েছে।

এদিকে হাফতার বাহিনীকে ঠেকাতে ত্রিপোলি সরকারের সশস্ত্র বাহিনী মেশিনগান স্থাপন করা আরও ট্রাক নিয়ে উপকূলীয় শহর মিসরাতা থেকে ত্রিপোলির দিকে যাচ্ছে।

জাতিসংঘ সমর্থিত লিবিয়ার প্রেসিডেন্সি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও দেশটির প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ মুস্তফা আল সেরাজ (৫৯) ও হাফতারের মধ্যে সমঝোতা চেষ্টা করেছিল জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশগুলো। তাঁরা দুজন গত মাসে দুবাইয়ে এক বৈঠকে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। হাফতারের প্রতি মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমর্থন রয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, এ দেশ দুটো থেকে সামরিক সহায়তা পেয়ে থাকেন হাফতার।

তবে সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রাশিয়া জানিয়েছে, তারা হাফতার বাহনীকে সাহায্য করছে না এবং ওই অঞ্চলে নতুন রক্তপাত এড়াতে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার প্রতি সমর্থন রয়েছে তাদের। নতুন সংঘাতের ঘটনায় লিবিয়ার সঙ্গে সীমান্তজুড়ে তিউনিশিয়া কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছে।

এদিকে এসব এলাকায় সংঘাত হলে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইতালিতে অভিবাসীদের ঢল নামে। তাই নতুন সংঘাতের ঘটনায় ইতালি খুব উদ্বিগ্ন বলে মন্তব্য করেছেন ইতালির উপপ্রধানমন্ত্রী মাতেও সালভিনি। তিনি বলেন, ‘আমাদের আগুনে পেট্রল নয়, পানি ঢালা প্রয়োজন। আমি আশা করি, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের কথা ভেবে মানুষ সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করবে না। এটা ধ্বংস ডেকে আনবে।’