নারীরা যেভাবে বদলে দিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত রুয়ান্ডাকে

১৯৯৪ সালের সেই ভয়াবহ গণহত্যার পর নারীরা মিলে এগিয়ে নিয়েছেন রুয়ান্ডাকে। ছবি: এএফপি
১৯৯৪ সালের সেই ভয়াবহ গণহত্যার পর নারীরা মিলে এগিয়ে নিয়েছেন রুয়ান্ডাকে। ছবি: এএফপি

ভয়াল সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনো আঁতকে ওঠেন এলিস উরুসারো কারেকেজি। ১০০ দিনের নৃশংস সেই হত্যাযজ্ঞে ঝরে যেতে দেখেছেন ৮ লাখ তাজা প্রাণ। সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিয়ে কীভাবে একটি দেশকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করা হয়েছিল, রুয়ান্ডার এই নারী আইনজীবী তার অন্যতম প্রধান সাক্ষী।

৭ এপ্রিল ১৯৯৪ থেকে ১৮ জুলাই ১৯৯৪—ঠিক ১০০ দিনের সেই গণহত্যায় সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল আফ্রিকার একসময়ের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ রুয়ান্ডা। গণহত্যার আগে মধ্য আফ্রিকার এই দেশের ২৬ হাজার ৩৩৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাস করতেন প্রায় ৭১ লাখ লোক। ১৮টি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশই ছিলেন হুতু। প্রধান সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ছিল তুতসি। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মাঝেমধ্যেই রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিত। কিন্তু ১৯৫৯ সালের নভেম্বরে সেটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। প্রায় এক বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা শেষে ১৯৬০ সালের ১৮ অক্টোবর হুতু নেতা গ্রেগইর কায়িবান্দার নেতৃত্বে আপৎকালীন স্বায়ত্তশাসিত সরকার ক্ষমতা দখল করে।

হুতুদের এই বিজয়ের পর নির্যাতিত হওয়ার আশঙ্কায় দেশ ছাড়তে শুরু করেন অনেক তুতসি নাগরিক। মাতৃভূমি ছেড়ে অনেকেই আশ্রয় নেন উগান্ডা ও বুরুন্ডির মতো দেশগুলোতে। উগান্ডায় পালিয়ে যাওয়া তুতসিরা মিলে গঠন করলেন রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট (আরপিএফ) নামের একটি রাজনৈতিক দল। ১৯৯০ সালের ১ অক্টোবর রুয়ান্ডায় হামলা চালিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয় আরপিএফ। ১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালি বিমানবন্দরের কাছে গুলি করে ভূপাতিত করা হয় প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানার বিমান। বিমানে থাকা প্রতিবেশী দেশ বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট তারিয়ামিরাইয়ের সঙ্গে সেখানেই নিহত হলেন প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানা। অকাট্য কোনো প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও রুয়ান্ডার সেনাবাহিনী পুরো ঘটনার দায় চাপাল সংখ্যালঘু তুতসিদের সংগঠন আরপিএফের ওপর। আর প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করে রুয়ান্ডায় থেকে যাওয়া তুতসিদের। তুতসিদের বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিলেন যেসব হুতু, হত্যা করা হয় তাঁদেরও। ১০০ দিনের নির্মম গণহত্যা শেষে যখন ক্ষমতা দখল করলেন তুতসি নেতা পল কাগামে, তত দিনে পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন ৮ লাখ মানুষ।

রুয়ান্ডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুইস মুশিকিওয়াবো। ছবি: এএফপি

যুদ্ধের ভয়াবহতা শেষে শক্ত হাতে রুয়ান্ডার হাল ধরলেন পল কাগামে। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠিত করবেন কাদের সহায়তায়? দেশটিতে তখন পুরুষ মানুষ খুঁজে পাওয়াই ছিল দুষ্কর! দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশই তখন নারী। মধ্য আফ্রিকার দেশটি আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে কি না, তা নিয়েই সংশয় দেখা দেয়। কারেকেজি নিজেই শোনালেন যুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থার কথা, ‘যাঁরা মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ ছিলেন পুরুষ। যাঁরা নিখোঁজ ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগও ছিলেন পুরুষ। এমনকি যাঁরা কারাবন্দী ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশ ছিলেন পুরুষ।’ রুয়ান্ডা তাহলে চলবে কীভাবে?

জীবনধারণের তাগিদে তাই প্রথা ভেঙে এগিয়ে এলেন রুয়ান্ডার নারীরা। পুরুষ নেই তো কী হয়েছে, দেশ পুনর্গঠনের সিংহভাগ দায়িত্ব তুলে নিলেন নিজেদের কাঁধে, একেকজন নারী হয়ে উঠলেন একেকজন নেতা। নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করতে দেশটির সংসদে পাস হলো একাধিক নারীবান্ধব আইন। প্রথা ভেঙে ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো রুয়ান্ডার নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির মালিকানা পাওয়ার অধিকার পান। স্বামীর অনুমতি ছাড়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি পান নারীরা, নিজেদের মালিকানাধীন জমি বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়ার অনুমতিও পান তাঁরা। ফলে আস্তে আস্তে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে শুরু করেন রুয়ান্ডার নারীরা।

রুয়ান্ডায় ঐতিহ্যগতভাবে নারীদের ‘সম্পত্তি’ হিসেবে দেখা হতো। সন্তান জন্ম দেওয়া ও ঘরকন্না সামলানোকেই তাঁদের প্রধান কাজ হিসেবে গণ্য করা হতো। সেই দিন বদলেছে অনেক আগেই। সংবিধান সংশোধন করে নিয়ম করে দেওয়া হলো, রুয়ান্ডার মোট সরকারি চাকরিজীবীর অন্তত ৩০ শতাংশ হবেন নারীরা। ২০০৩ সালের পর থেকে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের হারের দিক থেকে বিশ্বের অন্য অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে রুয়ান্ডা। বর্তমানে সেই হার গিয়ে ঠেকেছে ৬১ শতাংশে, পুরো বিশ্বেই যা সর্বোচ্চ। দেশটির সুপ্রিম কোর্টের সাতজন বিচারকের মধ্যে চারজনই নারী। সহকারী প্রধান বিচারকের পদটিও অলংকৃত করছেন একজন নারী।

রুয়ান্ডার মন্ত্রিপরিষদের অর্ধেক আসনও নারীদের দখলে। মন্ত্রিপরিষদের ২৬ জনের মধ্যে বর্তমানে ১৩ জনই নারী। নারীদের এভাবে এগিয়ে আসার পেছনে অনেকে কৃতিত্ব দিয়ে থাকেন দেশটির প্রেসিডেন্ট পল কাগামেকে। ক্ষমতায় বসার পর থেকেই নারীবান্ধব সব নীতিমালা তৈরি করে নারীদের এগিয়ে আসার পথ সুগম করেছেন তিনি।

নারীবান্ধব নীতিমালা তৈরি করে রুয়ান্ডার নারীদের এগিয়ে আসার পেছনে বড় অবদান রেখেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট পল কাগামে। ছবি: এএফপি

আগে রুয়ান্ডার মেয়েশিশুদের স্কুলে পাঠানোকে খুব একটা উৎসাহিত করা হতো না। ধীরে ধীরে এই পরিস্থিতিও বদলাতে শুরু করল। এমা ফুরাহা রুবাগুমিয়া স্মৃতিচারণা করলেন সেসব দিনের, ‘বিয়ে না দিয়ে আমাকে স্কুলে পাঠানোয় আমার বাবাকে অনেক বকেছিলেন আমার দাদা। আমার দাদা ভয় পেতেন, বিয়ে করে সন্তান নেওয়ার বদলে পড়াশোনা চালিয়ে গেলে আমি ভালো নারী হতে পারব না।’ পড়াশোনা করে যে ভুল করেননি, সেটির প্রমাণ তিনি দিয়েছেন। ৫২ বছর বয়সী রুবাগুমিয়া এখন রুয়ান্ডার ৪৯ জন নারী সাংসদদের মধ্যে একজন।

সেই সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীরা কতটা অসহায় ছিলেন, রুবাগুমিয়ার আরেক মন্তব্যে উঠে এসেছে সেই চিত্র। সেই সময়ের নারীরা পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুরুষ সদস্যদের মুখের ওপর কোনো কথা বলতে পারতেন না। রুবাগুমিয়া বলেছেন, ‘তখনকার সামাজিক অবস্থা এমন ছিল, আমার মা যে তাঁর শ্বশুরের সামনে গিয়ে আমাকে স্কুলে পাঠানোর পক্ষে যুক্তি দেবেন, সেই উপায়ও ছিল না। তাঁদের একমাত্র কাজ ছিল জমি চাষ করা ও সন্তানদের দেখভাল করা। তাঁরা নিজেরাও কখনো পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি। কিন্তু এখন সেই দিন আর নেই। আমি কি আমার সন্তানদের শিক্ষার অধিকারের জন্য লড়াই করব না? এখন গ্রামের অনেক নারী তাঁদের মেয়েদের স্কুলে পাঠান।’

রুবাগুমিয়াদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রেও এগিয়ে এসেছেন নারীরা। ৩৯ বছর বয়সী অ্যাগনেস নাইনাউমুন্তু বর্তমানে রুয়ান্ডায় নারীদের কফি উৎপাদনকারী সমিতির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ গণহত্যার আগে যেসব কাজ করা নারীদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল, তার মধ্যে একটি ছিল কফি উৎপাদন। নাইনাউমুন্তু বলেছেন, ‘তখন আমাদের কেবল একটিই কাজ ছিল। বিয়ে করা, গর্ভধারণ করা ও বাচ্চার জন্ম দেওয়া।’ রুয়ান্ডার সংসদে নারীদের উপস্থিতির হারের বিষয়ে গর্বিত নাইনাউমুন্তু বলেন, ‘সংসদে নারীদের উপস্থিতি দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হই, গর্বিত হই। তাঁদের দেখে আমরা সাহস পাই, নিজেদের কাজ ঠিকঠাকভাবে করলে আমরাও বড় পর্যায়ে যেতে পারব। তাঁদের দেখে আমরাও অনেকে স্থানীয় নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছি।’

রুয়ান্ডার বিরোধীদলীয় নেতা ভিক্টোয়ের ইনগাবিরে। ছবি: রয়টার্স

তবে নারী-পুরুষ সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে রুয়ান্ডা এখনো পুরোপুরি সফল হতে পারেনি বলেই মনে করছেন রুবাগুমিয়া। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে গেলেও পারিবারিক ক্ষেত্রে সমতা অর্জনের লড়াই এখনো চলছে বলেই মনে করেন তিনি, ‘এখনো আমরা শতভাগ সফলতা অর্জন করতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানসিকতার পরিবর্তন, আর এটি রাতারাতি হয় না। সরকারের নীতিমালা যত দ্রুত নারীবান্ধব হয়েছে, সব পরিবারের পরিস্থিতি তত দ্রুত বদলায়নি। বিশেষ করে অনেক পুরুষই এখনো আগের মানসিকতা থেকে বের হতে পারেননি। এমনকি অনেক নারী সাংসদের স্বামীরাও এখনো প্রত্যাশা করেন, স্ত্রীরা তাঁদের জুতা পরিষ্কার করে রাখবেন, জামা ইস্তিরি করে রাখবেন, বাথটাবে পানি ভরে রাখবেন।’

নিজের পরিবারের সদস্যদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনাকেই পরবর্তী চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন নারীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা সংস্থা রুয়ান্ডা উইমেন্স নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ম্যারি বালিকুঙ্গেরি। তিনি বলেছেন, ‘নিজের পরিবারের পুরুষ সদস্যরা না বদলালে আমাদের পক্ষে খুব বেশি পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তাঁদের মনোভাব পরিবর্তনের দায়িত্বটাও আমাদেরই নিতে হবে।’

এ বছরই রুয়ান্ডার গণহত্যার ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। ছবি: এএফপি

এই জেন্ডারবৈষম্য দূরীকরণে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের কথা ভাবছে রুয়ান্ডার জেন্ডার ও নারীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ও। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী সোলিনা নাইরাহাবিমানা বলেছেন, শিশুরা যেন ছোটবেলা থেকেই জেন্ডার সংবেদনশীল হিসেবে বেড়ে ওঠে, সেই মোতাবেক পরিকল্পনা গ্রহণ করছে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন ইউনিসেফের সঙ্গে কাজ করা জেন্ডার বিশেষজ্ঞ রেডেম্পটার বাতেতে। তিনি বলেছেন, ‘এখন থেকেই ছেলেশিশুদের নারী অধিকারসংক্রান্ত শিক্ষা না দেওয়া হলে ভবিষ্যতে সেই সুযোগ আর থাকবে না।’

নারী জাগরণের এই জোয়ারে ভেসেই রুয়ান্ডাকে আরও উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান সাংসদ রুবাগুমিয়া, ‘আমাদের কাঠামো আছে, আইন আছে, নীতিমালা আছে। গণহত্যার সেই ভয়াবহতা পেছনে ফেলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। অনেক অর্জনও জমা হয়েছে আমাদের। কিন্তু আমাদের আরও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সমাজের সব স্তর থেকে যেন বৈষম্য দূর হয়।’

তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ডট কম, ইউনিসেফ