নেলসন ম্যান্ডেলা— বিশ্বের বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বর্ণবাদ-পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি। বিভিন্ন সময় মোট ২৭ বছর কেটেছে কারাগারে। শান্তিতে নোবেল পান ১৯৯৩ সালে। ২০০২ সালের ৭ মে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল গ্রহণের অনুষ্ঠানে এই বক্তব্য দেন।
উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও আমন্ত্রিত অতিথি, সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা। আন্তরিক ধন্যবাদ। আজ আপনাদের সামনে কথা বলতে পেরে আমি আনন্দিত। সত্যি বলতে, আমি আজ রীতিমতো দ্বিধান্বিত। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রথিতযশা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন আমাকে সম্মানিত করতে যাচ্ছে? আপনারা নাকি আমাকে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল প্রদান করবেন। একজন অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ কয়েদিকে কেন এই সম্মান দেবেন? যার নেই কোনো অফিস, যে এখন শক্তিহীন, কারও ওপর প্রভাব বিস্তার করার কোনোই ক্ষমতা নেই। সেই আমাকে কেন আপনারা সম্মানিত করছেন? আপনাদের এই সম্মান আপনাদের বিনয়মাত্র। আমার মতো ধূসর চুলওয়ালা একজন বয়স্ক লোককে সম্মান দেখানোর জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। আমি আপনাদের বিনয়ের সঙ্গে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
আমরা আজ নিউইয়র্কে জড়ো হয়েছি জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক বিশেষ অধিবেশনের জন্য। আমার মনে হচ্ছে, সেই অধিবেশন চলাকালে এই সম্মাননা আমার জন্য বিশেষ কিছু। আমি সারা বিশ্বের সব শিশুর হয়ে এই সম্মাননা নিতে চাই। এই শিশুরাই তো আমাদের আগামী। আমাদের স্বপ্ন আর প্রত্যাশা তো তাদের ঘিরেই। আমার প্রজন্মের লোকদের শুধু একটা কাজ গভীর মনোযোগ দিয়ে করে যেতে হবে। আর তা হলো, আমাদের শিশুদের জন্য আগামীর পৃথিবীকে সুন্দর করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। তারা যেন তাদের পৃথিবীতে খুব ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে, নিঃশ্বাস নিতে পারে, সেদিকেই আমাদের নজর দিতে হবে।
একটা বিষয় আমাদের জন্য বেশ হতাশাজনক। একুশ শতকের প্রথম ভাগে পা রেখেও আমাদের ‘সবার জন্য সুন্দর পৃথিবী’ স্লোগান নিয়ে আকুতি জানাতে হয়। বিশ শতকেই তো আমরা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, জ্ঞানজগতে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলাম। তার পরও আমরা কেন পিছিয়ে? আমাদের মধ্যে অনেকেই নতুন পৃথিবী তৈরি করবেন বলে বিশ্বাস রাখেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা অন্যরকম এক সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করব। যেখানে থাকবে না কোনো দারিদ্র্য। সেই পৃথিবীতে অসাম্যের কোনো কু-ছায়া থাকবে না। আমাদের সেই পৃথিবীতে সব মানুষ জাতিবর্ণগোত্র-নির্বিশেষে শান্তি, নিরাপত্তা আর সমতার মধ্য দিয়ে দিন যাপন করবে। যেই পৃথিবীতে প্রতিটি দেশ, একেকটি জাতি পরস্পরের সঙ্গে শান্তিতে থাকবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হবে সমতা।
কিন্তু বর্তমানে আমরা সেই পৃথিবী থেকে অনেক দূরে বাস করছি। আমাদের বাস্তবতা এখন ভিন্ন কথা বলে। এই পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা আজ ক্রমাগত দারিদ্রে্যর সঙ্গে যুদ্ধ করছে। বঞ্চনা আর অত্যাচারের মধ্যে কাটছে প্রতিটি মানুষের দিন। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ আর সংঘাত কেড়ে নিচ্ছে অজস্র প্রাণ। দেশে দেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়ছে ক্রমাগত। ধনী দেশগুলোর সঙ্গে গরিব দেশগুলোর দূরত্ব আজ সহস্র যোজন।
সত্যিকারের সর্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমরা ক্রমাগত লড়ে যাচ্ছি। আমাদের শিশু, তরুণ প্রজন্ম এবং আগামী প্রজন্মকে এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে হবে। আমরা যা পারছি না, সেটা তাদের করে দেখাতে হবে। এই বাধা প্রতিবন্ধকতাকে তাদের জয় করতে হবে। এ জন্যই আমি আমার এই সম্মাননা আগামীর সেই যোদ্ধাদের উৎসর্গ করতে চাই।
বর্তমান পৃথিবীর সার্বিক অবস্থার চিত্র আমাদের ধারণার থেকেও মলিন। সে জন্য আমাদের হতাশ হলে চলবে না। নিজেদের হতাশার চাদরে জড়িয়ে ফেললে চলবে না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি আছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু করে যাওয়ার ক্ষমতা আছে। আমাদের সেই শক্তি সর্ম্পকে জানতে হবে, সেই কর্মক্ষমতা দেখিয়ে কিছু করতে হবে। পরির্বতন করতে হবে সমাজকে, সময়কে।
আমাদের পৃথিবীতে জমে থাকা দারিদ্র্য আর অত্যাচারের মাত্রা বাড়ছে ক্রমাগত। উন্নয়নশীল দেশ ও আফ্রিকা মহাদেশের সাধারণ মানুষ দারিদ্রে্যর ভার বহন করে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে তাদের কথা অবহেলার চোখে দেখা হতো। কিন্তু আস্তে আস্তে সেই ধারণা বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে বিভিন্ন দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর রাজনীতিবিদদের আচরণ। তাঁরা এখন দরিদ্র মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন। উন্নত দেশগুলোর মানুষ আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে।
আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশ এখনো উপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এখনকার তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বই পারে সেই শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, নাগরিকদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা আর অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে তারাই পুনঃ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বদলে দিতে পারে পৃথিবীকে। এই তরুণ নেতারাই হবে তাদের দেশের ভবিষ্যতের কারিগর।
পারস্পরিক সহযোগিতা বর্তমান পৃথিবীর একটি আলোচিত ধারণা। আমরা সারা পৃথিবীর আলোচিত ব্যক্তিত্বদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যাদের সহযোগিতায় আমরা দিকনির্দেশনা পেতে পারি। আমাদের শিক্ষা খাতে তারা অবদান রাখতে পারে। একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়নে শিক্ষা খাতের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। উন্নত শিক্ষাই পারে উন্নত নাগরিক তৈরি করতে। আফ্রিকার উন্নয়নে শিক্ষার বিকল্প নেই।
আফ্রিকাসহ সারা বিশ্বে যাঁরা শিক্ষা নিয়ে কাজ করছেন আমি তাদের ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানাই। আপনাদের কাজ আমাকে বেশ উৎসাহ দেয়। আমি এই সম্মাননা পদক থেকেও আপনাদের কাজকে সম্মানের চোখে দেখি। আপনারা তো পৃথিবী বদলে দেওয়ার কাজ করছেন। আমরা আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
আপনাদের সবাইকে আবারও ধন্যবাদ জানাই।
সূত্র: নেলসন ম্যান্ডেলা সেন্টার অব মেমোরি
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: জাহিদ হোসাইন খান