জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিতে চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন তিনি। তাঁদের বেশির ভাগ প্রশ্নই ছিল ভারতের শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ড ঘিরে কানাডার অভিযোগ নিয়ে।
গত জুনে কানাডার মাটিতে গুলি করে হত্যা করা হয় হরদীপ সিংকে। এ নিয়ে সম্প্রতি ট্রুডো বলেছেন, কানাডার নাগরিক হরদীপ হত্যার পেছনে ভারতীয় এজেন্টদের সংশ্লিষ্টতার ‘বিশ্বাসযোগ্য’ তথ্য রয়েছে তাঁর কাছে। নয়াদিল্লি এ অভিযোগ নাকচ করলেও বহু আগেই তারা হরদীপকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দিয়ে রেখেছিল।
নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের তোড়ে ট্রুডোর মুখে চিরচেনা সেই হাসি দেখা যায়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো উসকানি দেওয়ার বা সমস্যা ডেকে আনার চেষ্টা করছি না। আমরা নিয়মভিত্তিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার পক্ষে কাজ করছি।’ এ সময় এক সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেন, কানাডার মিত্ররাও কি তা–ই চায়? আরেকজন তো বলেই বসেন, ‘আপনাকে একা মনে হচ্ছে।’
সাধারণ চোখেই ট্রুডোকে দেখে মনে হচ্ছে, হরদীপ হত্যাকাণ্ড নিয়ে তিনি ভারতের সঙ্গে একাকী লড়াই করছেন। ফাইভ আইস বা পঞ্চনেত্র নামের একটি গোয়েন্দা তথ্য আদান–প্রদানকারী নেটওয়ার্ক থেকে তিনি হরদীপ হত্যায় ভারতের সম্ভাব্য সংশ্লিষ্টতার তথ্য পেয়েছেন। এই নেটওয়ার্কে কানাডাসহ পাঁচটি দেশ রয়েছে। তারা সবাই অটোয়ার মিত্র। তবে হরদীপ হত্যা ও ভারত ইস্যুতে তারা সাদামাটা বিবৃতি দিয়েই থেমে আছে। কানাডার সমর্থনে তেমন সোচ্চার হতে দেখা যায়নি কাউকে।
বলা চলে যুক্তরাজ্যের কথাই। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি বলেছেন, কানাডা যা বলেছে, তা তাঁর দেশ খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। একই সুরে অস্ট্রেলিয়া বলেছে, কানাডার অভিযোগ নিয়ে তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তবে সবচেয়ে হতাশাজনক হলো কানাডার প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ। অটোয়ার পক্ষে ওয়াশিংটনকে জোরালোভাবে গলা তুলতে দেখা যায়নি। চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘে ভারত প্রসঙ্গ তুলেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে হরদীপ ইস্যুতে নিন্দা জানাতে নয়। বরং, নতুন একটি বাণিজ্যিক পথ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতার প্রশংসা করতে।
এসবের জেরে খবর বেরিয়েছে যে কানাডা–যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। এমন খবর আবার মানতে নারাজ বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। তিনি বলেন, হরদীপ ইস্যু নিয়ে কানাডার সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে ভারত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে নানা বিবৃতিতে নরম সুরে কথা বলতে দেখা গেছে। বেশ কিছু বিবৃতিতে পশ্চিমা বিশ্বে ভারতের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের কথাও তুলে ধরা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের অনেকের ধারণা, কৌশলগত দিক দিয়ে ভারতের ব্যাপক গুরুত্বের তুলনায় কানাডার স্বার্থ এই মুহূর্তে পশ্চিমাদের কাছে ফিকে হয়ে এসেছে। ওয়াশিংটন–ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের কানাডা ইনস্টিটিউটের গবেষক জেভিয়ার ডেলগাডো বলেন, চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং তাদের পশ্চিমা ও ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় মিত্ররা একটি কৌশল হাতে নিয়েছে। ওই কৌশল বহুলাংশে ভারতকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে এই কৌশল এতটাই জরুরি যে চাইলেই তারা তা ছুড়ে ফেলতে পারবে না। ভূরাজনৈতিক এই বাস্তবতার কারণেই মিত্ররা কানাডাকে রক্ষায় এগিয়ে আসছে না বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কানাডা একটি দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। তা হলো, দেশটি পশ্চিমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মিত্র হলেও নিজে পরাশক্তি নয়। এটাকে দেশটির জন্য একটি দুর্বলতা বলে মনে করছেন কানাডা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ক্রিস্টোফার স্যান্ডস। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমরা শক্তিধর দেশগুলোর একটি জটিল পাল্লা দেখছি। এই পরিবেশে নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ নেই কানাডার। এখন যে বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে, সেটি হলো, সামরিক সক্ষমতা, শক্তি ও অর্থ, যেটি কানাডার নেই।’
এদিকে কানাডা যখন মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ ঋণহারের কারণে সংকটে, তখন খবর বেরিয়েছে কানাডার নির্বাচনে চীনের হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়ে। সমালোচকদের অনেকেই বলছেন, ওই হস্তক্ষেপ নিয়ে ওয়াকিবহাল ছিল ট্রুডোর মন্ত্রিসভা, তবে বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। আরেকটি বিষয় নিয়েও দেশের ভেতর তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছেন ট্রুডো। তা হলো, দেশটির সবচেয়ে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার পল বার্নার্ডোকে মধ্যমানের নিরাপত্তাসম্পন্ন কারাগারে স্থানান্তর করা। সব মিলিয়ে সেপ্টেম্বর নাগাদ কানাডায় ট্রুডোর জনপ্রিয়তা তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে কমেছে। দেশটির ৬৩ শতাংশ নাগরিক তাঁকে সমর্থন করছেন না।
কানাডায় ট্রুডো ক্ষমতায় এসেছিলেন ২০১৫ সালে। তখন থেকেই তিনি দেশটির রাজনীতিতে তারকা বনে যান। তবে তাঁর জনপ্রিয়তা কখনো এতটা কমেনি বলে উল্লেখ করেছেন গবেষণা সংস্থা এনগাস রেইড ইনস্টিটিউটের সভাপতি শাচি কার্ল। তিনি বলেন, এখন ট্রুডোকে ঘিরে অনেক প্রশ্নই উঠছে, যেমন, ‘আপনি কি ক্ষমতায় থেকে যেতে চাচ্ছেন?’ ‘আপনি কি পদত্যাগ করবেন?’
এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে কানাডার স্বার্থের দ্বন্দ্বে ট্রুডোকে একা মনে হলেও, এটি দেশের অভ্যন্তরে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের অনেকেই। কানাডার সংবাদপত্র গ্লোব অ্যান্ড মেইলের প্রধান রাজনৈতিক লেখক ক্যাম্পবেল ক্লার্ক বলেন, ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে কানাডার অভ্যন্তরীণ বিষয়সংশ্লিষ্ট প্রশ্নগুলো থেকে দূরে থাকতে পারছেন ট্রুডো।
ভারতের সঙ্গে কানাডার সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের ধাক্কা ট্রুডোকে কতটা সামলাতে হবে, তা সামনের দিনগুলো বলে দেবে। তবে আপাতত মিত্রদের জোরালোভাবে পাশে না পেলেও চলতি সপ্তাহটা তিনি শেষ করেছেন আরেক তারকা নেতা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে। তাই বলা চলে, একটি দিন হলেও ভালো সঙ্গে দিন কেটেছে ট্রুডোর।