শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি

আরেকটি ঝড়ের মুখে শ্রীলঙ্কা

আগামীকাল শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটাভুটি। এই নির্বাচন সামনে রেখে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।

পাসপোর্টের জন্য ইমিগ্রেশন দপ্তরে ভিড় করছেন শ্রীলঙ্কানরা। গতকাল রাজধানী কলম্বোয়
ছবি: এএফপি

কয়েক মাসের বিক্ষোভ–সহিংসতার পর শ্রীলঙ্কা এখন এমন এক অবস্থায়, যাকে কেউ কেউ ঝড়ের আগের ‘শান্ত অবস্থা’ বলে বর্ণনা করছেন। আগামীকাল বুধবার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর এই ঝড় উঠতে পারে।

বিক্ষোভের মুখে শ্রীলঙ্কা ছেড়ে পালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। তিনি সিঙ্গাপুর থেকে পদত্যাগপত্র পাঠানোর পর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। রনিল প্রধানমন্ত্রীর পদে বসেছিলেন একই রকম একটি পরিস্থিতিতে। গত মে মাসে জনতার বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন গোতাবায়ার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে। তখন ক্ষমতা ধরে রাখার অভিপ্রায়ে পার্লামেন্টে মাত্র একটি আসন থাকা ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) নেতা রনিলকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসান গোতাবায়া রাজাপক্ষে।

এখন এই রাজাপক্ষেদের দলের সমর্থন নিয়ে বুধবার শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটাভুটিতে তাঁরই জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এই নির্বাচন সামনে রেখে গতকাল থেকে শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা জারি করেছেন রনিল বিক্রমাসিংহে।

শ্রীলঙ্কায় চলমান এই আন্দোলনের সূচনা গত এপ্রিলে। এতে যাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁদের মধ্যে বামপন্থী দল ফ্রন্ট লাইন সোশ্যালিস্ট পার্টির (এফএলএসপি) ছাত্রসংগঠন রেভল্যুশনারি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন রয়েছে সামনের কাতারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই ছাত্রসংগঠনের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।

বিক্ষোভকারীরা এখন রনিল বিক্রমাসিংহকে ক্ষমতা থেকে তাড়াতে চাইছেন। রনিলের দল ইউএনপি এত দিন রাজাপক্ষেদের দল শ্রীলঙ্কা পদুজনা পেরামুনার (এসএলপিপি) প্রতিপক্ষ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছিল। শ্রীলঙ্কায় গত নির্বাচনে বিক্রমাসিংহের ইউএনপির ব্যাপক ভরাডুবি হয়। ২০১৯ সালের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাজাপক্ষেদের কাছেই বিক্রমাসিংহে পরাজিত হন। বিক্রমাসিংহে আপাতদৃষ্টে এসএলপিপি ও জেভিপি উভয়ের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হলেও তাঁর বিরুদ্ধে এই দুই দলের সঙ্গেই গোপন আঁতাত করার অভিযোগ রয়েছে। একমাত্র যে রাজনৈতিক শক্তি বিক্রমাসিংহের বিরুদ্ধে, সেটি এফএলএসপি। এই দলটি আত্মপ্রকাশ করে ২০১২ সালে মার্ক্সবাদী জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) দল থেকে বেরিয়ে একদল নেতা–কর্মীর হাত ধরে।

পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বিক্রমাসিংহের সুসম্পর্ক আছে বলে ধারণা করা হয়। এই সম্পর্কের ভিত্তিতে তিনি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে উদ্ধারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) প্রভাব রাখতে সক্ষম হবেন। মূলধারার রাজনীতির এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে এফএলএসপি একমত নয়।

অর্থ পরিশোধের সামর্থ্যের অভাবে জ্বালানি আমদানিতে তীব্র ঘাটতিই শ্রীলঙ্কায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভে ব্যাপক জনসমর্থন তৈরি করে। পুনরুদ্ধার কর্মসূচির আওতায় আইএমএফ ঋণ দিলে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট কিছুটা কাটতে পারে। তাতে দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও ফিরতে পারে। কিন্তু রেভল্যুশনারি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ চায় বলে মনে হচ্ছে।

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর এই স্টুডেন্ট ইউনিয়ন একগুচ্ছ দাবিদাওয়া তুলে ধরেছিল। সেই তালিকায় রনিল বিক্রমাসিংহের পদত্যাগের বিষয়টিও ছিল।

শ্রীলঙ্কার আন্তবিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্টস ফেডারেশনের প্রধান ওয়াসান্থা মুদালিগে বলেন, ‘আমরা তাঁকে (বিক্রমাসিংহে) এক ঘণ্টার জন্যও দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে চাই না। আমরা জোর দিয়ে বলছি, তিনি পদত্যাগ করুন। তিনি পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরা আমাদের বিক্ষোভ চালিয়ে যাব।’

১৪ জুলাই গোতাবায়া পদত্যাগপত্র পাঠানোর পরই বিক্রমাসিংহে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আসেন। এদিকে গোতাবায়ার দেশে ফেরারও সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, কোনো দেশই তাঁর আশ্রয়ের আবেদন অনুমোদন করছে না। তিনি দেশে ফিরলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।

রাজাপক্ষেদের প্রতি এখনো দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহল বৌদ্ধদের একাংশের সমর্থন রয়েছে। তারা রাজাপক্ষেদের ক্ষমতাচ্যুত করতে বিদেশি শক্তি, জাতিগত সংখ্যালঘু, এনজিও ও কলম্বোর অভিজাত ইংরেজিভাষী উদারপন্থী শ্রেণির কট্টরপন্থী ছাত্র প্রতিনিধি ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার কথা বলছে।

এই ঘরানার লোকজন বলছে, কতগুলো শক্তি একজোট হয়ে এই ষড়যন্ত্র করছে। শক্তিধর দেশগুলো যাতে শ্রীলঙ্কায় ইচ্ছামতো কাজ করতে পারে, সে জন্য দেশকে অস্থিতিশীল করতে তারা এটা করছে। এ জন্য প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে দায়ী করা হচ্ছে।

ভেন কিরুলাপানা ধম্মাউইজয়া থেরোর মতো অনেক প্রভাবশালী বৌদ্ধভিক্ষু এ বিষয়ে ইউটিউবে সোচ্চার রয়েছেন। কিরুলাপানা বলছেন, গোতাবায়ার উৎখাত দেশটির সিংহল বৌদ্ধ পরিচয়ের বিনাশ ডেকে আনবে। ষড়যন্ত্রের জন্য তিনি শ্রীলঙ্কার খ্রিষ্টান, তামিল ও মুসলমানদের দোষারোপ করেন। কিরুলাপানার মতো ব্যক্তিরা গণবিক্ষোভে ভূমিকা রাখার জন্য শ্রীলঙ্কার ক্যাথলিক চার্চের কঠোর সমালোচনা করছেন।

২০১৯ সালে ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ বোমা হয়। হামলাকারী হিসেবে নয়জন জঙ্গিকে শনাক্ত করা হয়। এই হামলার ঘটনায় গোতাবায়াকে দায়ী করেন আর্চবিশপ ম্যালকম রঞ্জিথ। এমন অবস্থানের জন্য রঞ্জিথের কঠোর সমালোচনা চলছে। সিংহল জাতীয়তাবাদীদের অনেকে রঞ্জিথের বিরুদ্ধে ‘সিংহল বৌদ্ধ জাতি শ্রীলঙ্কার’ বিরুদ্ধে ভ্যাটিকান ষড়যন্ত্র করার জন্য অভিযোগ তুলছেন।

আসেলা গুনারত্নে নিজেকে একজন আধ্যাত্মিক যোগী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। সিংহল বৌদ্ধদের মধ্যে তাঁর বড় সংখ্যায় অনুসারী রয়েছে। তিনি কার্ডিনাল রঞ্জিথকে ‘শয়তানের প্রতিনিধি’ আখ্যায়িত করেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজাপক্ষের অনুগতদের সম্মিলিত ক্ষোভ স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে শ্রীলঙ্কার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। বিষয়টি দেশটির রুগ্ণ অর্থনীতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

বুধবার শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে ভোট হলে বিক্রমাসিংহে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন বলে আশা করা হচ্ছে। তবে প্রেসিডেন্ট পদে আরও কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ইউএনপি থেকে বেরিয়ে যাওয়া সাজিথ প্রেমাদাসাও আছেন। তিনি দেশটির প্রধান বিরোধী দল সমজি জনা বালাওয়েগার (এসজেবি) প্রধান।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় অবিলম্বে আন্তর্জাতিক সহায়তা দরকার। তবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রেমাদাসাকে অনভিজ্ঞ বলেই মনে করেন অনেকে। আরেক মত হচ্ছে, সংকট মোকাবিলায় বিক্রমাসিংহেও ব্যর্থ হবেন। কারণ, তাঁর নেতৃত্বেই দলের গত নির্বাচনে চরম পরাজয় হয়েছে। তা ছাড়া শ্রীলঙ্কা সংকটের সমাধানের জন্য গত মে থেকে এখন পর্যন্ত তিনি কোনো উদ্যোগ দেখাতে পারেননি।