ঘূর্ণিঝড় ইয়াগির আঘাতে ভিয়েতনামে অন্তত ২৩৩ জন নিহত হয়েছে
ঘূর্ণিঝড় ইয়াগির আঘাতে ভিয়েতনামে অন্তত ২৩৩ জন নিহত হয়েছে

ইয়াগি যেভাবে এ বছর এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী, বিশ্বে দ্বিতীয় শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়

ঘূর্ণিঝড় ইয়াগির প্রভাবে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ভারী বৃষ্টি, বন্যা ও ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে করে এই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। চলতি বছর এশিয়ায় যতগুলো ঘূর্ণিঝড় হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল ইয়াগি। পাশাপাশি বেরিলের পর এ বছর বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ছিল এটি।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াগির মারাত্মক প্রভাব পড়েছে বেশ কয়েকটি দেশে। এর মধ্যে রয়েছে ফিলিপাইন, চীন, লাওস, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড। ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভিয়েতনাম। দেশটিতে অন্তত ২৩৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে। ইয়াগির আঘাতে গত সপ্তাহে এসব দেশে তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এখনো অনেক মানুষ নিখোঁজ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রাণহানির সংখ্যা আরও বাড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনওএএ) তথ্য অনুযায়ী, ঝড় যখন সবচেয়ে দুর্বল থাকে, তখন তাকে বলা হয় নিম্নচাপ। নিম্নচাপের বাতাসের গতি বেড়ে যদি ঘণ্টায় ৬৩ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়, তাহলে এটাকে বলা হয় মৌসুমি ঝড়। আর বাতাসের গতি বেড়ে ঘণ্টায় ১১৯ কিলোমিটার বা তার বেশি হলে সেটাকে বলে ঘূর্ণিঝড়।

বাতাসের গতির ওপর নির্ভর করে ঘূর্ণিঝড়ের শ্রেণি বিভাজন করা হয়। শ্রেণি আছে মোট পাঁচটি। প্রথম ক্যাটাগরির ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ হয় ১১৯ থেকে ১৫৩ কিলোমিটার। আর বাতাসের গতিবেগ যখন ঘণ্টায় ২৫২ কিলোমিটার বা তার বেশি হয়, তখন এটাকে বলা হয় অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। তৃতীয় থেকে ওপরের ক্যাটাগরির ঘূর্ণিঝড়কে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

১ সেপ্টেম্বর ফিলিপাইন সাগরে ঘূর্ণিঝড় ইয়াগির সৃষ্টি হয়। পরদিন ঘূর্ণিঝড়টি ফিলিপাইনে আঘাত হানে। আঘাত হানার পরে ঘূর্ণঝড়টির শক্তি কমতে থাকে। কিন্তু দক্ষিণ চীন সাগরে উষ্ণ পানির কারণে ঘূর্ণিঝড়টি আবার শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করে। যদিও এ ধরনের ঘটনা কিছুটা অস্বাভাবিক। এরপর ৪ সেপ্টেম্বর এটি তৃতীয় ক্যাটাগরির শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়।

পরদিন অর্থাৎ ৫ সেপ্টেম্বর আরও শক্তি সঞ্চয় করে ইয়াগি পঞ্চম ক্যাটাগরির ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পঞ্চম ক্যাটাগরির ঘূর্ণিঝড় হয় সবচেয়ে শক্তিশালী। সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ২৫২ কিলোমিটারের বেশি হলে পঞ্চম বা সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় বলা হয়। তো পঞ্চম ক্যাটাগরির ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার পর ইয়াগির গতি বেড়ে হয় ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৬০ কিলোমিটার।

দক্ষিণ চীন সাগরে উৎপত্তি হওয়া পঞ্চম ক্যাটাগরির চারটি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে একটি ইয়াগি। এর আগে দক্ষিণ চীন সাগরে সৃষ্ট অন্য তিনটি পঞ্চম ক্যাটাগরির ঘূর্ণিঝড় ছিল ২০২১ সালে রাই, ২০১৪ সালে রামমাসুন ও ১৯৫৪ সালে পামেলা।

পঞ্চম ক্যাটাগরির অর্থাৎ সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার পর ৬ সেপ্টেম্বর চীনের হাইনান প্রদেশে আঘাত হানে ইয়াগি। এ সময় ঘূর্ণিঝড়টির গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৩ কিলোমিটার। এর পরদিন চীনের হাইফং ও কুয়াং নিনহ প্রদেশের পাশাপাশি ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলে ইয়াগি আঘাত হানে। ভিয়েতনামে এক দশকের বেশি সময়ের মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়।

এরপর ধীর ধীরে ঘূর্ণিঝড়টির শক্তি কমতে থাকে। নিম্নচাপ হিসেবে এটি উঠে আসে মিয়ানমারেরর স্থলভাগে। এর প্রভাবে গত সপ্তাহে মিয়ানমারে ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে। এখনো বৃষ্টি চলছেই। অতি ভারী বৃষ্টির কারণে দেশটির রাজধানী নেপিডোসহ আশপাশের এলাকাগুলোয় মারাত্মক বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনই কি বড় কারণ

ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে প্রভাব ফেলছে, সে বিষয়ে এখনো ঐকমত্যে আসতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন ঘূর্ণিঝড় কীভাবে তৈরি হয়, এরপর কীভাবে এটি শক্তি সঞ্চয় করে, ঘূর্ণিঝড়ের গতি, স্থায়িত্ব এবং মোটের ওপর ঘূর্ণিঝড়ের বৈশিষ্ট্য।

তবে একটা বিষয়ে বিজ্ঞানীরা একমত যে বৈশ্বিক উষ্ণতা যত বাড়ছে, ঘূর্ণিঝড় তত বেশি শক্তিশালী হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে গত জুলাই মাসে ক্লাইমেট অ্যান্ড অ্যাটমস্ফেরিক সায়েন্স নামের একটি সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনের উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উপকূলের বেশি কাছাকাছি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের শক্তিও বাড়ছে দ্রুত আর স্থলভাগে বেশি সময় ধরে থাকছে।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা আরও বেশি উষ্ণ হওয়া এর প্রাথমিক কারণ হতে পারে। ১৮৫০ সালের পর সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রায় ০ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এর মধ্যে গত চার দশকেই সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।