জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু ও ডোনাল্ড ট্রাম্প
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাচ্ছেন না জাপানের প্রধানমন্ত্রী

জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু এখন পেরুর রাজধানী লিমায় অবস্থান করছেন। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক ফোরামের (এপেক) শীর্ষ বৈঠক শেষ করে স্থানীয় সময় আজ রোববার (১৭ নভেম্বর) তাঁর লিমা থেকে ব্রাজিলের উদ্দেশে যাত্রা করার কথা। সেখানে তিনি নেতৃস্থানীয় ২০টি রাষ্ট্রের জোট জি-২০-এর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন।

এর অর্থ হচ্ছে, আগামী কয়েক দিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি অবস্থান করবেন ইশিবা। এ কারণে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন শেষে দেশে ফেরার পথে যুক্তরাষ্ট্রে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করে দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতের সম্ভাবনা বিবেচনা করেছিলেন তিনি। অনির্ধারিত এ সফরের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আগাম একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার সম্ভাবনা বিবেচনা করে দেখেছিল জাপানের ক্ষমতাসীন সরকার।

আট বছর আগে জাপানের তৎকালীন সরকারের নেওয়া একটি সিদ্ধান্তের কারণে ওয়াশিংটনের সঙ্গে টোকিওর কিছুটা বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছিল। তেমন সম্ভাবনা এবার শুরুতেই এড়িয়ে যাওয়ার হিসাব-নিকাশ থেকে এবার ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি বিবেচনা করেছিলেন ইশিবা। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ের সম্ভাবনা নিয়ে যখন অনেকেই যখন নিশ্চিত ছিলেন না, তখন জাপান সরকারের নেওয়া একটি পদক্ষেপ ওয়াশিংটনের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি করেছিল। ফলে ইশিবা সে রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাইছেন না।

২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কিছুদিন আগে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তবে ট্রাম্পের সঙ্গে করেননি। আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম সেবার হিলারির জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে এতটাই আস্থার সঙ্গে প্রচারে নিয়োজিত ছিল যে জাপানের বাইরেও অনেকে ধরে নিয়েছিল যে হিলারিকে ঠেকানো ট্রাম্পের পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়। ফলে আবের হিসাব–নিকাশও সে রকম অবস্থান থেকে করা হয়েছিল।

তবে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর সেই ভুল সংশোধন করে নেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হয়েছিল আবের প্রশাসনকে। শেষ পর্যন্ত সাক্ষাতের একটি সুযোগ পেয়েছিলেন আবে। গলফের দামি একটি সেট উপহার হিসেবে নিয়ে ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে ট্রাম্পের বাসভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন আবে। এর পর থেকে আবে ও ট্রাম্পের মধ্যে ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলে জাপানে মার্কিন সেনা উপস্থিতির জন্য অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধের দাবি ট্রাম্প শুরুতে করলেও সম্ভবত জাপানের অতিথিপরায়ণ আচরণে মুগ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত তা থেকে বিরত ছিলেন তিনি।

অতীতের সেই শিক্ষা জাপানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে শুরুতেই ভুল পথে চালিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করেছে। এ কারণেই তিনি চেয়েছিলেন যে জি-২০ সম্মেলন শেষে ফিরে যাওয়ার আগে নিজে উপস্থিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানাবেন। ফলে ইশিবার প্রতিনিধিদল জাপান ত্যাগ করার আগে ট্রাম্পের নিজস্ব দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে রকম এক সংক্ষিপ্ত সফরের ব্যবস্থা করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা করেছিল। ইশিবা পেরুর রাজধানীতে অবস্থান করার সময়ও দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত থেকেছে। তবে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে কিছুটা হতাশ হয়েই ইশিবাকে এখন জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন শেষ করে দেশে ফিরে যেতে হচ্ছে।

জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সফরের সংবাদ সংগ্রহের জন্য জাপানি সাংবাদিকদের যে দল সফরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, লিমায় এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ব্রাজিল থেকে ইশিবা যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন কি না? উত্তরে ইশিবা বলেছেন, ট্রাম্পের দল তাঁদের এ ব্যাখ্যা দিয়েছে যে সম্প্রতি বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে সাক্ষাতের সময় চেয়ে অনেক বেশি আবেদন পাচ্ছেন ট্রাম্প। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দায়িত্ব গ্রহণের আগে সব অনুরোধ রক্ষা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না।

ফলে ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ না পেয়ে অনেকটা হতাশ হয়ে ইশিবাকে এখন আট দিনের সফর শেষে দেশে ফিরে যেতে হচ্ছে। তবে এ প্রসঙ্গে অন্য যে প্রশ্ন সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে, তা হলো ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার দায়িত্বকালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী অবস্থান জাপান হারাতে যাচ্ছে কি না? প্রশ্নের উত্তর অবশ্য এখনই খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিধারা ভবিষ্যতে কোন পথে এগোবে, তার ওপর এটি সম্ভবত অনেকাংশে নির্ভর করবে।

ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ না পেলেও পেরুতে অবস্থান করার সময় দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ইতিমধ্যে সেরে নিয়েছেন ইশিবা। এর একটি ছিল চীনের প্রধানমন্ত্রী সি চিন পিংয়ের সঙ্গে। দুই নেতা সেখানে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক গভীর করার সম্ভাবনা এবং দুই দেশের মধ্যে বিগত বছরগুলোতে দেখা দেওয়া কিছু সমস্যা মিটিয়ে ফেলার উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফলে ধারণা করা যায়, বাহ্যিক আচরণের দিক থেকে চীনকে মোকাবিলা করার শক্ত অবস্থান ইশিবা তুলে ধরলেও শেষ পর্যন্ত তিনি হয়তো নমনীয়তার পথে সরে আসার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে পারেন। গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে জাপান ও চীনের নেতারা নিয়মিত বৈঠকে বসার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন।

দ্বিতীয় বৈঠকটি ছিল ত্রিপক্ষীয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে মূলত আলোকপাত করা হয়েছে—উত্তর কোরিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তিন দেশ কোন কোন পদক্ষেপ নিতে পারে, তার ওপর। সুস্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত বৈঠকে গ্রহণ করা না হলেও ত্রিপক্ষীয় জোট আরও সুদৃঢ় করে তোলার উপায় নিয়ে তাঁরা মতামত দিয়েছেন। তবে বাইডেন অল্প দিনের মধ্যে বিদায় নিতে যাওয়ায় এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের প্রতি জনসমর্থন তলানির দিকে থাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে মিলিত হওয়ার বাইরে বৈঠকের কার্যকারিতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন।