বিশ্বের উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোতে নজিরবিহীন মাত্রায় দাবদাহ চলছে। এত বেশি গরমে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হওয়ায় প্রায়ই দাবদাহ দেখা যাচ্ছে। তীব্র গরমের কারণে মানুষের শরীরের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়। এতে পানিশূন্যতা, হিটস্ট্রোক, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, গত গ্রীষ্মে ইউরোপে গরমের কারণে ৬১ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ২০২৩ সালে গরমের মাত্রা আরও বেড়েছে।
অতিরিক্ত গরমের কারণে যখন মানুষের শরীরের তাপমাত্রা-নিয়ন্ত্রকগুলোর কার্যক্ষমতা কমে যায়, তখন ক্লান্তি, মাথাব্যথা, জ্বর দেখা দেয় এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মানুষের জন্য শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট) ধরে রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ে।
আরেকটি লক্ষণ হলো পানিশূন্যতা। মানুষের শরীর থেকে যদি বেশি পরিমাণ তরল বেরিয়ে যায়, অর্থাৎ গ্রহণ করা তরলের চেয়ে বের হয়ে যাওয়া তরলের পরিমাণ বেশি হয়, তখন পানিশূন্যতা দেখা দেয়।
শরীরের তাপমাত্রা যখন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) চেয়ে বেশি হয়, তখন হিটস্ট্রোক হতে পারে। একে গরমজনিত গুরুতর অসুস্থতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) সতর্ক করেছে, রাতের বেলা সর্বনিম্ন তাপমাত্রা যদি ক্রমাগতভাবে বেশি থাকতে দেখা যায়, তবে তা মানুষের শরীরের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। কারণ, এতে মানুষের শরীর ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সুযোগ পায় না।
চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও চীনে রাতের বেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও অনেক বেশি থাকতে দেখা গেছে। ডব্লিউএমওর তথ্যানুযায়ী, এ ধরনের পরিস্থিতিতে হার্ট অ্যাটাক ও মৃত্যুঝুঁকি থাকে।
জাতিসংঘের এ সংস্থা বলছে, সাধারণত দিনের বেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কত, সেদিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে রাতের বেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বেশি হলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি থাকে। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত মানুষদের জন্য এ ধরনের পরিস্থিতি বিপজ্জনক।
দাবদাহের সময় আর্দ্রতা বেশি থাকলেও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে। ঘাম বের হলে শরীর ঠান্ডা হয়। তবে আর্দ্রতা বেশি থাকলে ঘাম বের হতে পারে না।
তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার এ মিশ্রিত রূপকে ‘ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রা’ হিসেবে ডাকা হয়ে থাকে।
গবেষকেরা বলছেন, ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রায় একজন সুস্থ তরুণও ছয় ঘণ্টার মধ্যে মারা যেতে পারে।
এ ধরনের পরিস্থিতি খুব বিরল। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের ঘটনাও বাড়বে।
দাবদাহের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন বয়স্ক, শিশু (বিশেষ করে যাদের বয়স পাঁচ বছরের কম) ও শারীরিকভাবে অসুস্থ মানুষেরা।
মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ঘর্মগ্রন্থির সংখ্যা কমে যায়। এতে বয়স্কদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে যায়।
দাবদাহের সময় এসব ঘর্মগ্রন্থিকে দিনরাত কাজ করতে হয়। এতে এসব গ্রন্থির ওপর চাপ তৈরি হয় এবং এগুলোর কার্যক্ষমতা কমে যায়। এসব গ্রন্থি তখন কম ঘাম তৈরি করতে পারে। এতে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, গত গ্রীষ্মে ইউরোপে গরমের কারণে মারা যাওয়া ৬১ হাজার ৬৭২ জনের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষের বয়স ৮০ বছরের বেশি।
মানুষ কোথায় থাকে, কী করে তার ওপরও গরমজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি নির্ভর করে।
যাঁরা শহরে থাকেন, বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এবং অপরিকল্পিত বাড়িঘরগুলোতে বসবাসকারী মানুষদের বেশি করে গরমের মুখোমুখি হতে হয়।
নির্মাণশ্রমিকদের মতো যে শ্রমিকদের ঘরের বাইরে কাজ করতে হয়, তাঁরাও অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে আছেন।
খেলোয়াড়দের ঝুঁকির মাত্রা দ্বিগুণ। কারণ, শরীরচর্চার কারণেও তাপমাত্রা বেড়ে যায়।
গৃহহীন মানুষেরা গরমের কারণে অনেক ঝুঁকিতে থাকেন। কারণ, তাঁদের জন্য গরম এড়িয়ে চলার সুযোগ কম।
গরমের সময়ে কিছু ওষুধের ব্যবহারও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যেমন মূত্রবর্ধনকারী ওষুধগুলোর ব্যবহার শরীরে পানির পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
দাবদাহের সময় মানুষের প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা উচিত। এ সময় যতটা সম্ভব শরীরকে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করতে হবে। দিনের যে সময়ে সবচেয়ে বেশি গরম পড়ে, সে সময়ে বাইরে না যাওয়ার জন্য জনগণকে পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। সম্ভব হলে কয়েক ঘণ্টা ঠান্ডা জায়গায় কাটাতে হবে। যেমন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহ, গ্রন্থাগার কিংবা জাদুঘর।
গরমের সময়ে শরীরচর্চা না করা এবং মদ না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।