বৈশ্বিক উষ্ণতা রেকর্ড ছাড়াবে

এল নিনোর উপস্থিতি ছাড়াই বেশ কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ব্যাপক বাড়তে দেখা গেছে।

প্রচণ্ড রোদে ছাতা মাথায় রাস্তা পার হচ্ছেন পথচারীরা। গতকাল থাইল্যান্ডের ব্যাংককে

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ বছর বা আগামী বছর বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড হতে পারে। জলবায়ুবিশেষজ্ঞরা বলছেন, এল নিনো ফিরছে। এটি মূলত খরা পরিস্থিতি। জলবায়ুবিশেষজ্ঞদের মডেল অনুযায়ী, এত দিন প্রশান্ত মহাসাগরে লা নিনা বা বৃষ্টি পরিস্থিতি ছিল।

তিন বছর এ আবহাওয়া থাকার পর লা নিনার পরিবর্তে এল নিনো জায়গা করে নিচ্ছে। লা নিনার কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা কিছুটা কম ছিল। এ বছরের শেষের দিকে বিশ্ব এল নিনো বা উষ্ণ আবহাওয়া পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা ফিরে পেতে পারে।

এল নিনোর সময় বিষুবরেখা বরাবর পশ্চিম দিকে প্রবাহিত বাতাসের গতি কমে যায় এবং উষ্ণ পানি পূর্ব দিকে চলে আসে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠে উষ্ণ তাপমাত্রা তৈরি হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের পরিচালক কার্লো বোনটেম্পো বলেন, ‘বৈশ্বিক পর্যায়ে রেকর্ড ভাঙা তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সাধারণত এল নিনোর সম্পর্ক থাকে। এ পরিস্থিতি ২০২৩ সালে নাকি ২০২৪ সালে ঘটবে, তা এখনো জানা যায়নি। তবে আমার মনে হয়, এটি ঘটতে খুব বেশি দেরি নেই।’

বোনটেম্পো আরও বলেন, জলবায়ু মডেলগুলো থেকে প্রাপ্ত ধারণা অনুযায়ী গ্রীষ্মের শেষের দিকে এল নিনো দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া চলতি বছরের শেষের দিকে শক্তিশালী এল নিনো পরিস্থিতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

এযাবৎকালের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণ বছর হিসেবে রেকর্ড করে রেখেছে ২০১৬ সাল। ওই সময় শক্তিশালী এল নিনো পরিস্থিতির উপস্থিতি ছিল। তবে এল নিনোর উপস্থিতি ছাড়াই বেশ কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ব্যাপক বাড়তে দেখা গেছে।

গত আট বছর ছিল বৈশ্বিক উষ্ণতার রেকর্ডের ক্ষেত্রে শীর্ষ আটটি উষ্ণ বছর। এ থেকে দীর্ঘমেয়াদি উষ্ণায়ন প্রবণতার বিষয়টি প্রতিফলিত হয়। এই উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকে দায়ী করেন জলবায়ুবিশেষজ্ঞরা।

যুক্তরাজ্যের ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গ্রানথাম ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ফ্রেডরিক অটো বলেন, বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যে প্রচণ্ড দাবদাহ, খরা, দাবানলের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্টি পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে। এল নিনোর কারণে সৃষ্ট তাপমাত্রা বৃদ্ধি এ পরিস্থিতিকে আরও দুঃসহ করে তুলতে পারে।

গবেষক অটো বলেন, ‘যদি এল নিনো তৈরি হয়, তবে ২০১৬ সালের উষ্ণতার রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে ২০২৩ সালে। মানুষ যেভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো অব্যাহত রেখেছে, তাতে বৈশ্বিক উষ্ণতা আরও বাড়বে।’

ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু গবেষণা কেন্দ্র কোপার্নিকাস গতকাল বৃহস্পতিবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে গত বছরের বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টি মূল্যায়ন করা হয়। তাতে দেখা যায়, গত বছর ছিল বিশ্বের ইতিহাসে পঞ্চম উষ্ণ বছর।

২০২২ সালে সবচেয়ে উষ্ণ গ্রীষ্মকালের অভিজ্ঞতা হয়েছে ইউরোপের লোকজনের। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তীব্র বন্যার সম্মুখীন হয় পাকিস্তান। গত ফেব্রুয়ারি মাসে অ্যান্টার্কটিকার সমুদ্রের বরফের স্তর সর্বনিম্ন অবস্থায় নেমে আসে।

কোপার্নিকাসের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা শিল্প–পূর্ব যুগের তুলনায় এখন ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও বিশ্বে কার্বন ডাই–অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা বাড়ছেই।

বিপর্যয়কর উষ্ণায়নের দ্বারপ্রান্তে বিশ্ব

এর আগে গত মার্চ মাসে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মানুষের কর্মকাণ্ড পৃথিবীকে এমনভাবে পরিবর্তন করেছে, যা ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। এতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বাস্তুসংস্থানে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিজ্ঞানীদের প্যানেল আইপিসিসির এক প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। বিপর্যয়কর উষ্ণায়ন এড়াতে আরও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে।

বর্তমান বিশ্বে যে হারে কার্বন নিঃসরণ ঘটছে, তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের কার্বন নিঃসরণের যে সীমা রয়েছে, তা অতিক্রম করবে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা নাগালের বাইরে চলে যাবে। এই সীমার মধ্যে উষ্ণায়ন রাখা গেলে তা বিশ্বের প্রবালপ্রাচীর ও আর্কটিক সুরক্ষার বরফের স্তর টিকে থাকবে।