পুতিনের বক্তব্যে কি পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি বেড়ে গেল

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
ফাইল ছবি: রয়টার্স

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি স্থগিত করেছেন। গতকাল মঙ্গলবারের ভাষণে তিনি পরিষ্কার করে দিয়েছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে তিনি তাঁর কৌশল বদলাবেন না। একই সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য তিনি পশ্চিমাদের দায়ী করলেন।

অবশ্য পুতিন জোর দিয়ে বলেছেন, রাশিয়া পরমাণু চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করছে না। তাঁর ভাষণের কয়েক ঘণ্টা পর রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, পরমাণু চুক্তির প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধাশীল। ইতিপূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার আগে তাঁরা তথ্য বিনিময় অব্যাহত রাখবেন।

২০১০ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত নিউ স্টার্ট চুক্তি অনুযায়ী, পারমাণবিক অস্ত্রের পরিমাণ সীমিত রাখার পাশাপাশি দুই পক্ষ একে অন্যের পারমাণবিক স্থাপনা পরিদর্শনের সুযোগ ছিল। পুতিন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক পরীক্ষা শুরু করলে তাঁরাও পরীক্ষা চালাবেন। তাঁর এই বক্তব্যের ফলে স্নায়ুযুদ্ধের পর বন্ধ থাকা পারমাণবিক পরীক্ষা আবার শুরুর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

পুতিনের বক্তব্য উদ্বেগ বাড়াচ্ছে

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে শিগগিরই আলোচনার টেবিলে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বিশ্ব বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হবে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন মস্কোর চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্তকে ‘দুঃখজনক’ ও ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি গ্রিস সফরকালে বলেন, ‘রাশিয়া কী করছে, আমরা তা সতর্কভাবে দেখছি।’

পুতিনের ঘোষণা পারমাণবিক হুমকির চেয়ে বেশি কিছু। সত্যি, এটি খুবই ভয়াবহ বিষয়। কারণ, পুতিন ভবিষ্যতে কেমন আচরণ করবেন বা তাঁর মনে কী আছে, সে সম্পর্কে আমরা কেউ-ই ধারণা করতে পারি না
অ্যান্দ্রে কোলেশনিকভ, কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস

জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুন ‘ভালো সমাধান খুঁজে বের করতে’ রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আলোচনা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পোল্যান্ড সফরকালে নিউ স্টার্ট চুক্তির প্রসঙ্গ উল্লেখ না করে পুতিনের ইউক্রেনে হামলার কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি ‘যতই খারাপ পরিস্থিতি আসুক’, ইউক্রেনের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে পুতিন এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এমন ঘোষণা দিলেন, যাতে ইউক্রেন যুদ্ধ এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। এর আগে ব্লিঙ্কেন গত সপ্তাহে মন্তব্য করেছিলেন, চীন রাশিয়াকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিলে ‘ভয়াবহ সমস্যা’ তৈরি হবে।

রাশিয়া গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা চালায়। একই সময়ে রুশ বাহিনী রাজধানী কিয়েভের দিকে যাত্রা শুরু করে। তখন মনে হচ্ছিল, রুশ বাহিনীর হাতে কিয়েভের পতন সময়ের ব্যাপারমাত্র। কিন্তু পশ্চিমা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ইউক্রেন বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে ফিরে যায় রাশিয়ার বাহিনী।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে স্পষ্ট বিভোজন সামনে নিয়ে এসেছে। এই যুদ্ধের কারণে ন্যাটো জোটও নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় থাকা পুতিনের জন্য এখন বিরাট হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে এই জোট।

রুশ প্রেসিডেন্ট গতকাল মঙ্গলবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালাতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আমরা প্রথমে পরীক্ষা চালাব না। যুক্তরাষ্ট্র পরীক্ষা চালালে আমরাও পরীক্ষা চালাব।’

পুতিনের ভাষণের পর নিউ স্টার্ট চুক্তি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেল। গত মাসে ওয়াশিংটন অভিযোগ করেছিল, মার্কিন বিশেষজ্ঞ দলকে রুশ ভূখণ্ডে পারমাণবিক তৎপরতা পরিদর্শনের অনুমতি না দিয়ে মস্কো চুক্তির লঙ্ঘন করেছে। মস্কো চুক্তি স্থগিত করে এখন উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিল।

কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের অ্যান্দ্রে কোলেশনিকভ মনে করেন, ‘পুতিনের এই ঘোষণা পারমাণবিক হুমকির চেয়ে বেশি কিছু। সত্যি, এটি খুবই ভয়াবহ বিষয়। কারণ, পুতিন ভবিষ্যতে কেমন আচরণ করবেন বা তাঁর মনে কী আছে, সে সম্পর্কে আমরা কেউ-ই ধারণা করতে পারি না।’

অ্যান্দ্রে কোলেশনিকভ আরও বলেন, ‘পারমাণবিক যুদ্ধ এড়াতে ভালো হয় একটি চুক্তির মধ্যে থাকা। এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অর্থ, আমরা দিব্যচোখে ভবিষ্যতে সত্যিকারের এক পারমাণবিক যুদ্ধের আলামত দেখছি।’

নিউ স্টার্ট চুক্তি কী

২০১০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে নিউ স্টার্ট চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।

মস্কো ও ওয়াশিংটন কী পরিমাণ কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে, তার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত করে দিয়েছিল এই চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী, উভয় দেশের সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৫০টি পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের সুযোগ রয়েছে।

নিউ স্টার্ট চুক্তি কার্যকর হয় ২০১১ সালে। পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর ২০২১ সালে চুক্তিটির মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে চুক্তির শর্তগুলো দুই পক্ষই মেনে চলছে কি না, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পান যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পরিদর্শকেরা।

তবে করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চে ওই পরিদর্শন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তা আবার শুরু করতে গত বছরের নভেম্বরে মিসরে আলোচনায় বসার কথা ছিল মস্কো ও ওয়াশিংটনের কর্মকর্তাদের। তবে রাশিয়া ওই আলোচনা স্থগিত করে। এর পর থেকে কোনো পক্ষই আলোচনার নতুন তারিখ দেয়নি।  

দোনেৎস্কের বাখমুতের রাস্তায় ট্যাংক নিয়ে টহল দিচ্ছে ইউক্রেনের বাহিনী। ২১ ফেব্রুয়ারি তোলা

বিশ্বের মোট পারমাণবিক অস্ত্রের বেশির ভাগই স্নায়ুযুদ্ধকালের এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর নিয়ন্ত্রণে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের প্রভাবশালী দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হলেও রাশিয়া পরমাণু চুক্তিটি সচল রাখতে চায় বলে ইতিপূর্বে জানিয়েছিল।

মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, ইউক্রেনে হামলার জন্য কোনো অনুশোচনা বা দুঃখপ্রকাশ করেননি পুতিন। ক্রেমলিনের এই নেতার ওপর তাঁরা সজাগ দৃষ্টি রাখছেন।

কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের অ্যান্দ্রে কোলেশনিকভ বলেন, পুতিনের ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ তাঁর পরিকল্পনামাফিক হয়নি। এতে ইউক্রেনের মানুষ দুর্দশায় পড়েছেন, রুশ সেনাবাহিনীতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এই যুদ্ধে অংশ নিতে পুতিন প্রচুর রুশ নাগরিককে সেনাবাহিনীতে যেতে বাধ্য করেছেন।

তাহলে পুতিনের এই আগ্রাসন কি বড় ভুল ছিল? হিসাব-নিকাশে বড় ভুল ছিল? পুতিন এসব প্রশ্নের কোনোটিই স্বীকার করবেন না। তিনি বারবারই এই যুদ্ধের জন্য পশ্চিমাদের দায়ী করে যাচ্ছেন।

মঙ্গলবার পুতিন আবার বলেছেন, ‘আমি আবার বলতে চাই, পশ্চিমারা এই যুদ্ধ শুরু করেছে। আমরা কেবল তাদের থামাতে শক্তি প্রয়োগ করছি।’

পুতিন বলেন, ‘পশ্চিমা প্রভাবশালীরা তাদের লক্ষ্য গোপন রাখেনি। তারা রাশিয়ার কৌশলগত পরাজয় নিশ্চিত করতে চায়। এর অর্থ কী দাঁড়ায়? এর অর্থ, তারা আমাদের একেবারে শেষ করে দিতে চায়।’

পুতিন বলেন, ‘এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, তারা আঞ্চলিক সংঘাতকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। তারা সেটা করতে চাইলে আমরা উপযুক্ত জবাব দেব। কারণ, এটা আমাদের দেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন।’

পুতিন বেশ আস্থার সঙ্গে বললেন, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করতে পারবে রাশিয়া। ইউক্রেনকে পশ্চিমা সমর্থন সত্ত্বেও এই যুদ্ধে তাঁরাই জয়ী হবেন।

অ্যান্দ্রে কোলেশনিকভ বলেন, পুতিন তাঁর বক্তব্যে সমঝোতার কোনো ইঙ্গিত দেননি। তিনি সমাধানের কোনো শান্তিপূর্ণ পথ খুঁজছেন বলেও মনে হচ্ছে না।

 অ্যান্দ্রে কোলেশনিকভ বলেন, পুতিনে বক্তব্য শুনে মনে হলো, যুদ্ধ অব্যাহত রাখার অধিকার যেন তাঁর রয়েছে। এটা খুব খারাপ লক্ষণ। তিনি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন। তিনি এই বিপর্যয় এখনই শেষ করতে প্রস্তুত নন। মনে হচ্ছে, তিনি এই যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন।’