প্রভাবশালীরা নিরেট সত্যকে ভয় পান। সত্যকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কখনো কখনো সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিলিয়ে–মিশিয়ে প্রকাশ করেন তাঁরা। এতে জনগণকে তাৎক্ষণিকভাবে বোকা বানানো যায়।
কিন্তু সত্য কখনো চাপা থাকে না। সত্যের এমন শক্তি, সব শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে সে আলোর দিকে আসবেই। তবে বেশির ভাগ সময়ই প্রকৃত সত্যকে সামনে আনতে কাউকে না কাউকে বড় ত্যাগস্বীকার করতে হয়। এরপরই আসে বিজয়ের বারতা।
আজ ৯ আগস্ট তেমনই এক চেপে রাখা সত্য প্রকাশের ঘটনা শোনাব আপনাদের।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওভাল অফিসসহ হোয়াইট হাউসের গুরুত্বপূর্ণ সব টেলিফোন আলাপ গোপনে রেকর্ড করে সুরক্ষিত রাখা হতো। এটা চালু করা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের আমল (১৯৩৩-৪৫) থেকে। কিন্তু নিক্সন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়, সব টেলিফোন আলাপ রেকর্ড করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এটা ছিল তাঁর নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো অথবা নিজের ফাঁদে নিজেই ধরা পড়া।
আজ থেকে ৫২ বছর আগে ফিরে যাই।
১৯৭২ সাল, জুন মাস।
মাস চারেক পরে নভেম্বর মাসের ৭ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী রিচার্ড নিক্সন। যিনি তখনকার প্রেসিডেন্ট। ১৯৬৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর নানা কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে নিজেকে একপ্রকার অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছেন তিনি। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছেন। কমিউনিস্ট দেশ চীন সফর করে পেলেন বিপুল অভ্যর্থনা। চেয়ারম্যান মাও সে–তুংয়ের সঙ্গে বৈঠক করলেন। চীনা নেতারা তাঁকে কাঁটাচামচ দিয়ে খাবার তুলে দিলেন।
সব মিলিয়ে নিক্সন তখন তুমুল জনপ্রিয়। এ কারণে অবধারিতভাবে রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়নও পেয়েছেন। অন্যদিকে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী সাউথ ডাকোটার সিনেটর জর্জ ম্যাকগভর্ন।
নির্বাচনের বাকি মাত্র চার মাস। তাই সারা যুক্তরাষ্ট্রে বইছে নির্বাচনী হাওয়া।
ওই বছরের ১৭ জুন একটা ঘটনা ঘটে গেল। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির ওয়াটারগেট নামের হোটেলের ছয়তলায় ছিল ডেমোক্রেটিক পার্টির ন্যাশনাল কমিটির কার্যালয়। এই দপ্তর থেকে ডেমোক্রেটিক পার্টির নির্বাচনসংক্রান্ত সবকিছু তদারক করা হতো। স্বাভাবিকভাবেই দপ্তরটি মুখর থাকত নেতা–কর্মীদের আনাগোনায়।
ওই দিন খুব ভোরে পাঁচজন লোক ঢুকে পড়ে ওই দপ্তরে। ঢুকে তাঁরা সেখানকার টেলিফোন সেটে ছোট মাইক্রোফোন লাগাতে শুরু করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, এখানে কী কথাবার্তা হয় তা নজরদারি করা। পাশাপাশি সেখানকার অনেক কাগজের ছবি তুলতে থাকেন তাঁরা।
সেদিন সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন ফ্রাঙ্ক উইলস নামের এক ব্যক্তি। তিনি খেয়াল করলেন, ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির অফিসের দরজায় ‘লক ডাক্ট টেপ’ লাগানো। এই টেপ লাগানো থাকলে দরজা এমনভাবে বন্ধ হয় যেন লকটা আটকে না যায়। এর অর্থ হলো ভেতরে কেউ আছে। কিন্তু উইলসের মনে কোনো সন্দেহ তৈরি হলো না। তিনি লক থেকে টেপটা খুলে দিয়ে আবার কাজে ফিরে গেলেন।
কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে এসে দেখলেন আবার লকে টেপ লাগানো। এবার তাঁর সন্দেহ হলো। খবর দিলেন পুলিশকে। তাঁরা এসে পাকড়াও করল পাঁচজনকে। তাঁদের হাতে পাওয়া গেল আড়ি পাতার যন্ত্র আর ২ হাজার ৩০০ ডলার। প্রায় সবই ১০০ ডলারের নোট।
শুরু হলো পাঁচ অনুপ্রবেশকারী ও ১০০ ডলারের নোটের সিরিয়াল নম্বর নিয়ে তদন্ত। গণমাধ্যমের সব সন্দেহ রিপাবলিকান প্রার্থী রিচার্ড নিক্সনকে ঘিরে। প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হলো তাঁকে। কিন্তু তাঁর ওই এক কথা, তিনি বা তাঁর দলের কেউ এ ঘটনায় জড়িত নন। এসব অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র।
ওয়াশিংটন পোস্টের দুই তরুণ রিপোর্টার কার্ল মিল্টন বার্নস্টেইন আর বব উডওয়ার্ড কোমর বেঁধে নামলেন।
১০ অক্টোবর তাঁরা প্রকাশ করলেন তাঁদের বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। ‘ডিপ থ্রোট’ ছদ্মনামে নামে গোপন এক সূত্রের বরাতে তাঁরা জানালেন, ওয়াটারগেট হোটেলে ডেমোক্রেটিক পার্টির কার্যালয়ে আড়ি পাতার ঘটনায় স্বয়ং প্রেসিডেন্ট নিক্সন জড়িত। চারদিকে হই হই পড়ে গেল। কিন্তু নিক্সন আবারও বললেন, নির্বাচন সামনে রেখে এটা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়।
নিক্সন হয়তো জানতেন, বিলে অভিশংসনের পক্ষেই ভোট বেশি পড়বে। তাই আর অসম্মানের পথে যাননি তিনি। ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট অর্থাৎ আজকের এই দিনে তিনি প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগপত্র জমা দেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া একমাত্র প্রেসিডেন্ট তিনি।
যথারীতি ৭ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে গেল। ওয়াটারগেটের ঘটনা কোনো প্রভাব ফেলতে পারল না। বিপুল বিজয় পেলেন নিক্সন। ৫০টি রাজ্যের মধ্যে ৪৯টিতে জয়ী হলেন তিনি। ডেমোক্রেটরা জিতল মাত্র একটিতে। শপথ নিলেন দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
কিন্তু সাংবাদিক কার্ল বার্নস্টেইন আর বব উডওয়ার্ড দমে গেলেন না। প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। তাঁদের প্রতিবেদনে বেরিয়ে এল, অনুপ্রবেশকারীরা একবার নয়, মোট চারবার ঢুকেছিল ডেমোক্রেটিক পার্টির ন্যাশনাল কমিটির কার্যালয়ে। অন্যদিকে পাঁচ অনুপ্রবেশকারীর নামধাম সব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে লাগল। এঁদের মধ্যে ছিলেন জেমস ম্যাককর্ড নামের একজন। সাবেক সিআইএর কর্মকর্তা ম্যাককর্ড কাজ করছিলেন নিক্সনের নির্বাচনী প্রচারের নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে।
কার্ল বার্নস্টেইন আর বব উডওয়ার্ড তাঁদের অনুসন্ধানে বের করলেন, অনুপ্রবেশকারীদের হাতে যে ১০০ ডলারের নোট পাওয়া গিয়েছিল, সেই নোটের সিরিয়াল নম্বরের সঙ্গে নিক্সনের নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহের জন্য তোলা নোটের মিল রয়েছে। সন্দেহ আরও জোরালো হলো নিক্সন প্রশাসনের দিকে। কিন্তু তাদের ওই এক কথা—সব ষড়যন্ত্র।
রিচার্ড নিক্সনের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বিজয়ী হয় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। ১৯৭৩ সালে পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হন কার্ল বার্নস্টেইন ও বব উডওয়ার্ড। আর সেই ডিপ থ্রোটের পরিচয় বের হয় ২০০৫ সালে। তিনি ছিলেন সিআইএয়ের সাবেক এজেন্ট মার্ক ফেল্ট।
এবার পুরো ঘটনার তদন্তে নামল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ও সিআইএ। মার্কিন সিনেটে তদন্ত কমিটি গঠিত হওয়ার প্রস্তাব পাস হলো ৭৭-০ ভোটে। সিনেটের সেই শুনানি রুদ্ধদ্বার ছিল না, সরাসরি দেখানো হলো টেলিভিশনে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওভাল অফিসসহ হোয়াইট হাউসের গুরুত্বপূর্ণ সব টেলিফোন আলাপ গোপনে রেকর্ড করে সুরক্ষিত রাখা হতো। এটা চালু করা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের আমল (১৯৩৩-৪৫) থেকে। কিন্তু নিক্সন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়, সব টেলিফোন আলাপ রেকর্ড করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এটা ছিল তাঁর নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো অথবা নিজের ফাঁদে নিজেই ধরা পড়া।
সিনেটে তদন্ত কমিটি গঠিত হওয়ার পর তখনকার অ্যাটর্নি জেনারেল এলিয়ট রিচার্ডসন এ মামলায় সরকারি কৌঁসুলি (প্রসিকিউটর) হিসেবে আর্চিবাল্ড কক্সকে নিয়োগ দেন।
মি. কক্স কাজে নেমে পড়লেন। প্রথমেই তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে ১৯৭২ সালের পূর্ববর্তী সব টেপ চাইলেন। নিক্সন দেখলেন, এ তো ঘোর বিপদ। তিনি টেপ তো দিলেনই না, উল্টো এই কক্সকে বরখাস্ত করে বসলেন। প্রেসিডেন্টের এমন সিদ্ধান্তে বেজায় ক্ষিপ্ত হলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। প্রতিবাদে তিনিও পদত্যাগ করলেন। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে দিনের পর দিন ব্যানার হেডলাইন হতে লাগল। দিন যত গড়াল, সন্দেহের তির ততই নিক্সনের নিকটবর্তী হচ্ছিল।
অন্যদিকে তদন্তকারীরাও চাপ অব্যাহত রাখছিলেন। টেপ না দিয়ে আর উপায় নেই নিক্সনের। তিনি টেপ দিলেন ঠিকই কিন্তু ১৯৭২ সালের ২০ জুনের একটি কথোপকথনের ১৮ মিনিট গায়েব করে দেন নিক্সনের সুন্দরী সেক্রেটারি রোজ মেরি ওডস। এ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁর জবাব, ওই অংশটি নষ্ট হয়ে গেছে।
বাকি টেপগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজে তদন্তকারীরা নিশ্চিত হলেন ওয়াটারগেটের ঘটনার সঙ্গে নিক্সন জড়িত।
১৯৭৪ সালের ২৭ জুলাই তদন্ত কমিটি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অভিশংসন করতে কংগ্রেসে বিল আনার প্রস্তাব করল।
কিন্তু নিক্সন অভিশংসনের মুখোমুখি হতে চাননি। তিনি হয়তো জানতেন, বিলে অভিশংসনের পক্ষেই ভোট বেশি পড়বে। তাই আর অসম্মানের পথে যাননি তিনি। ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট অর্থাৎ আজকের এই দিনে তিনি প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগপত্র জমা দেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া একমাত্র প্রেসিডেন্ট তিনি।
ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরার্ড ফোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে নিক্সনকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু নিক্সন প্রশাসনের এক ডজনের বেশি কর্মকর্তা সাজা এড়াতে পারেননি।
রিচার্ড নিক্সনের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বিজয়ী হয় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। ১৯৭৩ সালে পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হন কার্ল বার্নস্টেইন ও বব উডওয়ার্ড। আর সেই ডিপ থ্রোটের পরিচয় বের হয় ২০০৫ সালে। তিনি ছিলেন সিআইএয়ের সাবেক এজেন্ট মার্ক ফেল্ট।
নিক্সনের পদত্যাগের দুই মাস আগেই ১৯৭৪ সালের ১৫ জুন প্রকাশিত হয় কার্ল বার্নস্টেইন ও বব উডওয়ার্ডের লেখা বই ‘অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন’। বছর দুই পরে যা নিয়ে বানানো হয় সাড়া জাগানো সিনেমা। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে কতটা লড়াই করতে হয়েছে, তা ফুটিয়ে তোলা হয় এই সিনেমায়।
সেক্যুলার ইহুদি কার্ল বার্নস্টেইনের বয়স এখন ৮০। লেখালেখি করছেন। মাঝেমধ্যে সিএনএনের পর্দায় হাজির হন একজন বিশ্লেষক হিসেবে। অন্যদিকে বব উডওয়ার্ডের আসল নাম রবার্ট আপসার উডওয়ার্ড। বয়স হয়েছে ৮১। লেখালেখি করছেন। তবে দুই বন্ধু এখনো কফি খেতে খেতে ওয়াটারগেটের রহস্যভেদের স্মৃতি রোমন্থন করেন কি না, সে তথ্য কোথাও পাওয়া গেল না।
(বিবিসিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র অবলম্বনে)