সম্প্রতি সমুদ্রের তলদেশে তিনটি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়ার কথা জানিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো।
নতুন সন্ধান পাওয়া তিনটির মধ্যে দুটি জাহাজের ধ্বংসাবশেষের বয়স হাজার বছর। এখন কথা হলো, সমুদ্রের তলদেশে এমন আর কত জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকতে পারে?
১৯০০ সালে গ্রিসের অ্যান্টিকিথেরা দ্বীপের কাছের সাগরে ডুবে থাকা একটি রোমান জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। পণ্যবাহী জাহাজটি দুই হাজার বছরের বেশি সময় আগে ডুবে গিয়েছিল। জাহাজটির ধ্বংসাবশেষ থেকে বিভিন্ন প্রাচীন নিদর্শন উদ্ধার করা হয়েছিল।
জাহাজটির ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার হওয়া প্রাচীন নিদর্শনগুলোর স্থান হয় জাদুঘরে। এই নিদর্শন উদ্ধারের ১০০ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও এই নিদর্শনগুলো মানুষকে এখনো মুগ্ধ ও বিস্মিত করছে।
বিশ্বের সাগর-মহাসাগরের নিচে আরও অনেক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে বলে মনে করা হয়। এগুলো এখনো আবিষ্কৃত হওয়ার অপেক্ষায়। এগুলো আবিষ্কৃত হলে, তা থেকে নানা নিদর্শন উদ্ধার হলে, তা মানুষকে বিস্মিত করবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
ইউনেসকো সম্প্রতি ‘স্কেরকি ব্যাংক’ নামে পরিচিত সমুদ্র এলাকায় অভিযান চালায়। এটি ‘স্কেরকি চ্যানেল’ নামেও পরিচিত। ঝুঁকিপূর্ণ এই নৌপথ পূর্ব ও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরকে যুক্ত করেছে।
নৌপথটি হাজারো বছর ধরে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এই দীর্ঘ সময়ে এখানে শত শত জাহাজ ডুবেছে।
স্কেরকি ব্যাংক এলাকায় পরিচালিত অভিযানে আটটি দেশের বিজ্ঞানী-গবেষকেরা অংশ নেন। অভিযানে পানির নিচে ব্যবহারযোগ্য রোবটসহ অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
অভিযান শেষে তিনটি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। জাহাজ তিনটি প্রথম শতাব্দী খ্রিষ্টপূর্ব, দ্বিতীয় শতাব্দী খ্রিষ্টাব্দ ও উনিশ বা বিশ শতকের।
ইউনেসকোর ধারণা, বিশ্বের সাগর-মহাসাগরের নিচে এখনো অনেক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যেতে পারে, যেগুলোর খোঁজ আগে কখনো পাওয়া যায়নি।
নেদারল্যান্ডসে একটি মোটরওয়ে নির্মাণের সময় সমুদ্রতলে দৈবক্রমে একটি প্রাচীন নৌকা পাওয়া যায়। ডোঙা নৌকাটি ১০ হাজার বছর আগের বলে ধারণা করা হয়।
পরিস্থিতিগত আলামত সাক্ষ্য দেয়, এই এলাকার নৌপথে ১০ হাজার বছরের বহু আগে নৌ চলাচল শুরু হয়েছিল।
আবার প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে একদল শিকারি দীর্ঘ নৌপথ অতিক্রম করেছিল বলে ধারণা করা হয়।
যে সমুদ্রেই নৌ চলাচলের নজির আছে, সেখানেই ধ্বংসাবশেষ (নৌযান) রয়েছে বলে অনুমান করা হয়।
এখন বিশ্বের সাগর-মহাসাগরগুলোর নিচে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এখানে আছে রুপাবোঝাই জলদস্যু জাহাজ, পণ্যবাহী নৌযান কিংবা বিলাসবহুল রাজকীয় জাহাজ। আছে প্রাচীন মাছ ধরার জাহাজ, আধুনিক ডেস্ট্রয়ার ও সাবমেরিন। এই তালিকায় ১৯ শতকের তিমি শিকারের জাহাজ যেমন আছে, আবার আছে টাইটানিকের মতো বিশাল যাত্রীবাহী লাইনার।
এখন পর্যন্ত যে জাহাজগুলোর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হচ্ছে, তা প্রত্নতাত্ত্বিকদের বিমোহিত করেছে। এগুলো থেকে উদ্ধার নিদর্শন বিশ্বের জাদুঘরগুলোকে সমৃদ্ধ করছে।
যেমন গ্রিসের অ্যান্টিকিথেরা দ্বীপের কাছে আবিষ্কৃত জাহাজটির ধ্বংসাবশেষের কথা বলা যায়। এখান থেকে ‘রহস্যময়’ জ্যোতির্বিদ্যা-সম্পর্কিত একটি ঘড়ি উদ্ধার করা হয়েছিল। ঘড়িটিকে কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার হিসেবে বিবেচনা করেন।
সাগর-মহাসাগরের নিচে ঠিক কতগুলো জাহাজ পড়ে আছে? কতগুলো জাহাজের খবর এখনো জানা যায়নি?
বিশ্বে জাহাজডুবি নিয়ে বেশ কয়েকটি তথ্যভান্ডার (ডেটাবেজ) রয়েছে। তবে জাহাজডুবির তথ্যের বিষয়ে প্রতিটি ডেটাবেজে থাকা পরিসংখ্যানে পার্থক্য দেখা যায়।
অনলাইনভিত্তিক এমনই একটি ডেটাবেজ ‘রেক সাইট’। তারা নিজেদের এ-সম্পর্কিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডেটাবেজ হিসেবে দাবি করে।
রেক সাইটে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪০টি নৌযানডুবির তথ্য আছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৭৯ হাজার ১১০টির অবস্থান জানা বলে ডেটাবেজে উল্লেখ রয়েছে।
অন্যদিকে গ্লোবাল মেরিটাইম রেকস ডেটাবেজে ২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি নৌযানডুবির তথ্য রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিছু নৌযান এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এক হিসাব অনুযায়ী, শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই প্রায় ১৫ হাজার জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। এই যুদ্ধের সময় প্রশান্ত থেকে আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যাওয়া অনেক যুদ্ধজাহাজ ও ট্যাংকারের কথা আজ বিস্মৃত।
সমুদ্রে নৌযান বা জাহাজের ধ্বংসাবশেষের যে তথ্য এখন পর্যন্ত নথিভুক্ত রয়েছে, তাকে মোটেই পূর্ণাঙ্গ চিত্র বলা যাবে না। প্রাপ্ত তথ্যকে প্রকৃত সংখ্যার একটি ছোট ভগ্নাংশ মনে করা হয়।
পানির নিচের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষার বিষয়ে ইউনেসকোর একটি কনভেনশন রয়েছে। ২০০১ সালে কনভেনশনটি গৃহীত হয়। ইউনেসকোর এক বিশ্লেষণে বলা হয়, বিশ্বের সমুদ্রের নিচে ৩০ লাখের বেশি অনাবিষ্কৃত নৌযান বা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আছে।