বাড়ছে লাশের সারি, এখনো ধ্বংসস্তূপে আটকা বহু মানুষ

ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে থাকা মেয়ের নিথর হাতটি ধরে আছেন অসহায় বাবা মেসুত হানসার। এ ছাড়া আর কিছুই যেন করার নেই তাঁর। ভয়াবহ ভূমিকম্পে ভবনধসে প্রাণ গেছে তাঁর ১৫ বছরের মেয়ে ইরমাকের। গতকাল তুরস্কের কাহরামানমারাশ শহরে
ছবি: এএফপি

ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া ১৫ বছরের মেয়ে ইরমাকের হাত শুধু বের হয়ে আছে। সেই হাত ধরে বসে আছেন বাবা মেসুত হানসার। তুরস্কের কাহরামানমারাস শহরের এই দৃশ্য ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত এলাকাগুলোর করুণ পরিস্থিতির প্রতীকী চিত্র হয়ে এসেছে। গত সোমবারের ভূমিকম্পে তুরস্কের দক্ষিণ ও সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের হাজার হাজার ভবন ধসে পড়েছে। এগুলোর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে একের পর এক লাশ বের করা হচ্ছে। এখনো যাঁরা জীবিত আছেন, তাঁদের উদ্ধারে জোর চেষ্টা চলছে। তবে বৈরী আবহাওয়া ও ভূমিকম্পে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উদ্ধারকর্মীরা সব জায়গায় যেতে পারছেন না।

এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা সাত হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে তুরস্কে ৫ হাজার ৪৩৪ এবং সিরিয়ায় ১ হাজার ৮৩২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দুই দেশে মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

তুরস্কের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার এলাকায় এখন ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা। এসব এলাকায় ৫ হাজার ৭৭৫টি ভবন ধসে পড়েছে। আর ভূমিকম্পে সিরিয়ায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা দেশটিতে ১১ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে বেশি বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মানচিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, এসব এলাকায় ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষের বসবাস। ভূমিকম্পের কারণে সেখানকার সবাই কোনো না কোনোভাবে সংকটে পড়েছেন। দুই দেশের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে লাখো মানুষ এখন খোলা আকাশের নিচে আছেন। তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশটিতে ভূমিকম্পে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ। আহত হয়েছেন ২০ হাজারের বেশি মানুষ।

উদ্ধার ব্যাহত বৈরী আবহাওয়ায়

সিরিয়া ও তুরস্ক—দুই দেশেই শীত পড়ছে। সেখানে তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে থাকছে। আবার কিছু কিছু এলাকায় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচেও থাকছে। অনেক এলাকায় বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া ভূমিকম্পের কারণে অনেক এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে জ্বালানিসংকট। তুরস্কের বেসরকারি উদ্ধারকারী সংস্থা একেইউটির সমন্বয়কারী মুরাত হারুন অনগোরেন বলেছেন, তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল অংশজুড়ে ধ্বংসলীলা চলেছে, রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ, তারপর আবার আবহাওয়া এত ঠান্ডা যে জমে যাওয়ার মতো। এতে উদ্ধারকারীদের সেখানে পৌঁছাতে বড় সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। আর সিরিয়ায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক এল-মোস্তাফা বেনলামিল বলেন, ‘ভবন ধসে গেছে। ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা যেসব রাস্তা ব্যবহার করি, সেগুলো ধসে গেছে।’

তুরস্কের কাহরামানমারাস যেন বিধ্বস্ত এক নগরী

এই পরিস্থিতির কারণে ধ্বংসস্তূপের নিচে স্বজন আটকা পড়লেও অনেকের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া করার কিছু থাকছে না। এ রকম একজন তুরস্কের আদিয়ামান শহরের বাসিন্দা আলী উনলু। সোমবার ভোরে ভূমিকম্পের পরপরই মায়ের বাসার দিকে ছুটেছিলেন তিনি। গিয়ে দেখতে পান, বাসাটি ধসে পড়েছে। আর তাঁর মা এর নিচে চাপা পড়েছেন। এক দিন পার হলেও মাকে উদ্ধারে তিনি কিছু করতে পারেননি। ঘটনার পর উদ্ধারকারীদের জন্য অপেক্ষা শুরু করেন উনলু। একপর্যায়ে ফোন করেন তিনি। তবে সংযোগ পাননি। পরে নিজেরাই উদ্ধারকাজে নামেন। এক আত্মীয়কে উদ্ধারও করেছেন। তবে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে মাকে বের করতে পারেননি।

তুরস্কে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০টি প্রদেশ। সেখানকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ও উদ্ধারকাজে গতি আনতে তিন মাসের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য দেশটির আনতালিয়া অঞ্চলের হোটেলগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

সিরিয়ায় উদ্ধারকাজে বাধা

ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল তুরস্কের গাজিয়ানতেপ প্রদেশ। সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা এটি। ফলে তুরস্কের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিরিয়ার আলেপ্পো, ইদলিব, হামা ও লাতাকিয়া প্রদেশ। এসব প্রদেশের অনেক এলাকা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরোধী শিবিরের নিয়ন্ত্রণে। ফলে সেসব এলাকায় ঢুকতে পারছে না উদ্ধারকারীরা। এমনকি বাশার আল-আসাদ সরকারও এতে সাহায্য করছে না।

ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপে জীবিত বা মৃত কেউ আটকা পড়ে আছেন কি না, খুঁজছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও উদ্ধারকর্মীরা। কাহরামানমারাস, তুরস্ক

এ প্রসঙ্গে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালিনা বেয়ারবক বলেন, রাশিয়াসহ আন্তর্জাতিক মহলের উচিত সিরিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করা, যাতে ভুক্তভোগীদের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়। এখন অস্ত্র ফেলে দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময়। সিরিয়ার এসব এলাকায় যাতে সাহায্য পৌঁছানো বাধাগ্রস্ত না হয়, সে আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থার মুখপাত্র জেনস লার্ক।

গৃহযুদ্ধের কারণে সিরিয়ার এই সীমান্তবর্তী এলাকা এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত। সেখানকার ৪০ লাখ মানুষ ত্রাণসহায়তার ওপর নির্ভরশীল। ভূমিকম্পের কারণে সেখানে এমন সাহায্যপ্রার্থীর সংখ্যা আরও বেড়েছে।

মানুষ বড় অসহায়

তুরস্ক ও সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস। গতকাল তিনি বলেন, জীবন বাঁচাতে সময়ের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় এখন। প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি ঘণ্টা চলে যাচ্ছে আর জীবিত মানুষকে উদ্ধারের সুযোগ কমে যাচ্ছে।

সত্যিকার অর্থেই এই পরিস্থিতি দেখা গেল তুরস্কের আনতাকিয়া শহরে। সেখানে একটি ভবনের ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে এক নারীর আর্তনাদ শোনা যায়। তিনি উদ্ধারকারীদের ডাকছিলেন। এর পাশেই বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সাংবাদিক এক শিশুর লাশ দেখতে পান। সেখানে তখন বৃষ্টি পড়ছিল। স্থানীয় একজনের সঙ্গে ওই সাংবাদিকের কথা হয়।

ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়া মোহাম্মেত রুজগার নামে পাঁচ বছরের এক শিশুকে বের করে আনছেন উদ্ধারকর্মীরা। হাতায়, তুরস্ক

ওই ব্যক্তি রয়টার্সের সাংবাদিককে বলেন, ‘ভবনের নিচে চাপা পড়া এমন অনেকেই চিৎকার করছে, সাহায্য চাইছে। কিন্তু কেউ আসছে না। আমরা বিধ্বস্ত।’

সিরিয়ার হামা শহরে গতকাল কয়েকটি পরিবারের মৃত স্বজনদের দাফন সম্পন্ন হয়। সেখানে দাহান নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘প্রতিটি জায়গা এখন ভয়ংকর। আমি আমার জীবনে এমন দৃশ্য দেখিনি।’