লন্ডনে একটি হাসপাতালের বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছোট্ট তাফিদাকে বাঁচার সুযোগ দিতে আদালতের কাছে আকুতি জানিয়েছেন মা সেলিনা রাকিব। লাইফ সাপোর্ট খুলে নিয়ে তাফিদার জীবনের অবসান ঘটানো হবে কি হবে না; এ নিয়ে শুক্রবার যুক্তরাজ্যের হাইকোর্টে টানা পাঁচ দিনের শুনানি শেষ হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার মা সেলিনা রাকিব আদালতে শেষবারের মতো তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
বিচারক অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকডোনাল্ড সেলিনার কাছে জানতে চান, তাঁর মেয়ে আদালতকে কী বলত? জবাবে সেলিনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার মেয়ে বলত, “আমি এমন কী অন্যায় করেছি যে আমার সঙ্গে এসব হচ্ছে? কেন আমাকে বাঁচার সুযোগ দেওয়া হবে না? আমার মা–বাবাই আমার সব। তাঁরা আমার জন্য সবকিছু করবেন। এটা আমার জীবনের বিষয়। অন্য কেউ এর মানে বুঝবে না। আমি কেবল বেঁচে থাকার সুযোগ চাচ্ছি”।’
মাত্র পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু তাফিদা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে হাসপাতালের বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই পরিস্থিতিকে বলা হয় ‘কোমা’। তাফিদার আর জেগে ওঠার সম্ভাবনা নেই এমন যুক্তিতে পূর্ব লন্ডনের রয়্যাল লন্ডন হাসপাতাল লাইফ সাপোর্ট খুলে নিয়ে শিশুটির জীবনের অবসান ঘটাতে চায়। আর মা–বাবা নিজস্ব খরচে ইতালির জেনোয়ার গ্যাসলিনি চিলড্রেন হসপিটালে নিয়ে তাফিদাকে আরও চিকিৎসা দিতে চান। যে কারণে বিষয়টি আদালতে গড়ায়।
তাফিদার বাবা মোহাম্মদ রাকিব (৪৫) ও মা সেলিনা রাকিব (৩৯) দুজনেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। তাঁদের বাড়ি সিলেটে। যুক্তরাজ্যে এই পরিবারের বসবাস পূর্ব লন্ডনের নিউহ্যাম এলাকায়। সন্তানকে নিজস্ব খরচে ইতালিতে নিয়ে চিকিৎসা করাতে তাঁরা তহবিলও সংগ্রহ করেছেন। ইতালির চিকিৎসকেরা তাফিদাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করতে রাজি। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, লাইফ সাপোর্ট দিয়ে তাফিদাকে আরও ১০ থেকে ২০ বছর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু যুক্তরাজ্যের রয়্যাল লন্ডন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তাফিদার জেগে ওঠার সম্ভাবনা নেই। অঙ্গহানি ও যন্ত্রণা এড়াতে জীবনের অবসান ঘটানো তাফিদার জন্য উত্তম।
পেশায় আইনজীবী সেলিনা রাকিব আদালতকে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, তাফিদা ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে। আমি বুঝি, আমার কণ্ঠ শুনে সে সাড়া দেয়। তাফিদা এভাবে বেঁচে থাকলেও আমি, তাঁর বাবা ও ভাই তাঁকে দেখতে পারব, আদর করতে পারব। মৃত্যু নিশ্চিত করা তাফিদার জন্য কোনো মঙ্গলজনক কাজ হতে পারে না।’
গত সাত মাসে তাফিদার তিনবার অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে সেলিনা বলেন, ‘বেঁচে থাকার জন্য আমার মেয়ে আরও লড়াই করতে প্রস্তুত।’
সেলিনা জানান, মেয়েকে সার্বক্ষণিক সঙ্গ দিতে তিনি আইনপেশার কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। প্রতিদিন রাত দুইটা পর্যন্ত মেয়ের সঙ্গে থাকেন। পাঁচ ঘণ্টা পর আবার মেয়ের বিছানার পাশে হাজির হন। প্রতিদিন মেয়ের সামান্যতম নড়চড়গুলোও ধারাবাহিকভাবে লিখে রাখছেন, যা তিনি আদালতে উপস্থাপন করেন।
এ ছাড়া আদালতে কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়। একটি ভিডিওতে তাফিদার সার্বক্ষণিক নার্স তাকে বারবার ডেকে হাত বাড়াতে বলছেন। অন্য এক ভিডিওতে দেখা যায়, তাফিদা নার্সের আঙুল ধরেছে।
তাফিদাকে বাঁচানোর দাবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে আদালতে হাজির হন মোহাম্মদ রাকিব ও সেলিনা দম্পতি। একই দাবি জানিয়ে আদালতের সীমানাবেষ্টনীতে ঝোলানো হয় তাফিদার ছবিসহ ব্যানার। পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কের প্রবেশপথসহ আরও বিভিন্ন স্থানে তাফিদাকে বাঁচানোর এমন বার্তা চোখে পড়ে। যুক্তিতর্ক শেষ। এখন বিচারকের রায়ের ওপর নির্ভর করছে তাফিদার জীবন।
আরও পড়ুন...
গভীর ঘুমে ছোট্ট তাফিদা, আইনি লড়াই আদালতে