চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের সম্পর্ক ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে বুধবার তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মন্তব্য করেছেন। দ্বীপ দেশটির আকাশসীমায় পরপর চীনের বেশ কয়েকটি বিমান ঢুকে পড়ার ঘটনার কয়েক দিন পর এমন মন্তব্য করলেন তিনি। এদিকে উত্তেজনা প্রশমনে পরিস্থিতি নিয়ে ফোনে আলাপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। রয়টার্সের খবর।
বেইজিং ও তাইপের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা উত্তেজনা বর্তমানে এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। চীন গণতান্ত্রিক এই ভূখণ্ডকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে থাকে। সম্প্রতি তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা অঞ্চলে চীনের সামরিক বিমানের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় উত্তেজনার পারদ এখন চরমে।
তাইওয়ানের আকাশসীমায় গত শুক্রবার থেকে বিগত চার দিনে চীনের প্রায় দেড় শ যুদ্ধবিমান ঢুকে পড়ার কথা জানিয়েছে তাইপে। তাইওয়ানকে চীনের অব্যাহতভাবে হয়রানি করে যাওয়ারই এটি একটি অংশ বলে আখ্যা দিয়েছে তাইপে। সবশেষ গত মঙ্গলবার তাইপের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে বেইজিং।
চীনের সঙ্গে বর্তমান সামরিক উত্তেজনা নিয়ে তাইওয়ানের পার্লামেন্টে একজন আইনপ্রণেতার প্রশ্নের জবাবে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী চিউ কিউ-চেং বলেন, ৪০ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে দুই দেশের মধ্যে এত উত্তেজনা তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর আর দেখেননি। তিনি আরও বলেন, সম্পর্ক এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে স্পর্শকাতর তাইওয়ান প্রণালিজুড়ে ‘ভুল-বোঝাবুঝির গোলাগুলি’ শুরুর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
পার্লামেন্টারি কমিটিতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিউ-চেং বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে আমি মনে করি অবস্থা এখন গুরুতর।’ তাইওয়ানের ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধজাহাজসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র বাবদ ৮৬০ কোটি মার্কিন ডলারের বিশেষ সামরিক ব্যয় বরাদ্দের বিষয় পর্যালোচনা করে এ কথা বলেন তিনি।
ইতিমধ্যে চীন হুমকি দিয়ে বলেছে, প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে হলেও তাইওয়ানকে নিজের দখলে নেওয়া হবে। তবে তাইওয়ান বলছে, তারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। উত্তেজনার জন্য চীনকে দায়ী করে তাইপে আরও বলেছে, তারা তাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষা করবে।
চিউ বলেন, তাইওয়ানে আগ্রাসন চালানোর সক্ষমতা চীনের রয়েছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে তারা ‘পুরোদমে’ আগ্রাসন চালানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। তিনি আরও বলেন, এখনই সক্ষমতা থাকলেও অনেক কিছু বিবেচনায় নিয়ে চীন সহজে কোনো যুদ্ধে জড়াবে না।
তাইওয়ানের সামরিক রসদের প্রধান জোগানদাতা যুক্তরাষ্ট্র দেশটির প্রতি তার দৃঢ় প্রতিশ্রুতির কথা নিশ্চিত করেছে। একই সঙ্গে চীনের সমালোচনা করেছে তারা। বেইজিংয়ের অভিযোগ, অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করে ও যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে তাইওয়ানকে সমর্থনের ওয়াশিংটনের নীতিতে উত্তেজনা বাড়ছে।
তাইওয়ান প্রসঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে মঙ্গলবার কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তাঁরা তাইওয়ান চুক্তি মেনে চলতে সম্মত হয়েছেন। তাইপে ও বেইজিংয়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে সির সঙ্গে এ আলোচনা করার কথা জানান তিনি।
জো বাইডেন বলেন, ‘আমি সি চিন পিংয়ের সঙ্গে তাইওয়ান নিয়ে কথা বলেছি। আমরা তাইওয়ান চুক্তি মেনে চলতে সম্মত হয়েছি।’ বাইডেন আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, তিনি চুক্তির অন্যথা করবেন না।’
প্রেসিডেন্ট বাইডেন ওয়াশিংটনের দীর্ঘদিনের ‘এক চীন নীতির’ কথাও বলেছেন। এ নীতির আওতায় এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়নি ওয়াশিংটন।
তাইওয়ান সম্পর্ক চুক্তি বা ‘তাইওয়ান রিলেশনস অ্যাক্ট’ অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র বেইজিংয়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখবে। আর শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাইওয়ানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সহায়তা করবে।
বেইজিং ও তাইপের উত্তেজনার মধ্যেই মিশিগান সফর শেষে হোয়াইট হাউসে ফিরে সাংবাদিকদের কাছে সি চিন পিংয়ের সঙ্গে তাইওয়ান নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা জানান বাইডেন।
চলমান উত্তেজনার জন্য বেইজিংকে দোষারোপ করে আসছে তাইওয়ান। অন্যদিকে তাইওয়ানের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করছে চীন।
যুক্তরাষ্ট্র গত রোববার চীনকে তাইওয়ানের কাছাকাছি সামরিক তৎপরতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেন, ‘তাইওয়ানের কাছে চীনের উসকানিমূলক সামরিক তৎপরতার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। এতে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হচ্ছে। ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’
এর আগে গত মাসেও বাইডেন ও সি ফোনালাপ করেন। ফোনালাপের পর হোয়াইট হাউসের প্রকাশ করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, ফোনালাপে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কৌশলগত বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে দুই দেশের অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে, তার পাশাপাশি যেসব ক্ষেত্রে দুই দেশের স্বার্থ, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা রয়েছে, সেগুলো নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছে।
বেইজিং-তাইপের টান টান উত্তেজনার মধ্যে বুধবার চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ইয়াং জাইচিংয়ের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের বৈঠকে বসার কথা ছিল। নিজেদের মধ্যে কৌশলগত বিবাদ গভীরতর হলেও বেইজিং ও ওয়াশিংটন পরস্পরের মধ্যকার নিবিড় যোগাযোগ বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে জানা গেছে।