এ বছর আমাদের বহু বছরের কৃতকর্মের অনিবার্য ফল সামনে এসে হাজির হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি এমন কোনো দুর্যোগ নয়, যা দৈবচয়নের ভিত্তিতে আমাদের মধ্যে এসেছে, বরং আমি বলব এটি একটি ‘মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক’ দুর্যোগ। এটি আমাদের বহু প্রকৃতিবিরুদ্ধ বদভ্যাস এবং ভয়ংকর প্রাণঘাতী আচরণের অনিবার্য পরিণাম।
বাদুড় থেকে মানবদেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হলো বেপরোয়া গতিতে নগরায়ণের বিকাশ এবং প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতা নীতি ভেঙে প্রকৃতিবিরুদ্ধ ধ্বংসাত্মক জীবন বেছে নেওয়ার ফল। বেপরোয়া গতিতে শিল্পায়ন ও মানুষের সমকালীন ভ্রমণ ও পর্যটন অভ্যাস এই মহামারি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে। একইভাবে সংকটটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশ্বের একত্র হওয়ার অক্ষমতা প্রমাণ করেছে, উচ্চতর বিশ্বায়নের পেছনে সরকারগুলো এখনো কতটা পিছিয়ে।
এই ব্যর্থতাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি করোনাভাইরাস আঘাত হানার আগেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বহু দেশে মানুষে মানুষে, দেশে দেশে বিভক্তি ও ঘৃণা ছড়ানো জাতীয়তাবাদ ও জনতুষ্টিবাদকে সাধারণ মানুষ সমর্থন দিয়েছে। তাদের উন্মাদনা বলা যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। বছরটি যদিও সবার জন্য খুবই কঠিন, তারপরও ২০২১ সাল পাঁচ কারণে সবার কাছে স্বাগত জানানোর মতো হয়ে উঠেছে।
এই পাঁচ কারণের প্রথম ও প্রধান কারণ হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়। আপনি যখন ঘুমিয়ে আছেন, তখন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর লোকটি টুইটারে কি–না–কি লিখে একটা বিরাট ঝামেলা বাধিয়ে দিল কি না, অন্তত এই দুশ্চিন্তা নিয়ে এখন থেকে আর আপনাকে ঘুম থেকে জাগতে হবে না। যুক্তরাষ্ট্র খুব শিগগির রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্ষম মানুষের হাতে এসে পড়বে। আমেরিকাকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনকারী রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম নেতা জো বাইডেন গদিতে বসার পর সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক পরিবেশের ওপর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করবে।
সারা বিশ্বে সবার জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে গিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশগুলোকে সর্বোচ্চ মাত্রায় ব্যস্ত থাকতে হবে। এটি আগামী বছরের নভেম্বরে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠেয় জলবায়ু সম্মেলনের অ্যাজেন্ডাকেও ঘুরিয়ে দিতে পারে
ট্রাম্পের রাজনৈতিক পতনের কারণে ইউরোপের দুই ঘোর ‘ট্রাম্পিয়ান’ নেতা হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান এবং পোল্যান্ডের উপপ্রধানমন্ত্রী ও কার্যত সরকারপ্রধান জোরাস্লাভ কাচজিনোস্কি ইতিমধ্যে একধরনের এতিম হয়ে পড়েছেন। ইউরোপে রাজনৈতিক বাতাস ঘুরতে শুরু করেছে। জার্মানিতে ২০২১ সালে এবং ফ্রান্সে ২০২২ সালে সাধারণ নির্বাচন। কিছুদিন আগেও এই দুই দেশের জনতুষ্টিবাদীরা যেভাবে রাজনৈতিক বাতাস ঘুরিয়ে দেওয়ার দাবি তুলছিলেন, তাঁদেরও এখন তেমন সোচ্চার দেখা যাচ্ছে না। যুক্তরাজ্যে জনতুষ্টিবাদী ও ‘যুক্তরাজ্যের ট্রাম্প’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইতিমধ্যে তাঁর রাজনৈতিক পাল ঘুরিয়ে ফেলতে শুরু করেছেন। ট্রাম্পের হারের পর তিনি শেষ পর্যন্ত তাঁর ব্রেক্সিট–গুরু ডোমিনিক কামিংসকে বরখাস্ত করেছেন এবং তিনি এই ইঙ্গিত দিচ্ছেন, ট্রাম্প-উত্তর বিশ্বে তিনি নতুন গণতান্ত্রিক ভাবধারায় তাঁর রাজনীতিকে সাজাবেন।
আনন্দিত হওয়ার দ্বিতীয় বড় খবরটি হলো, কোভিড-১৯–এর ভ্যাকসিন প্রক্রিয়াধীন। এই ভ্যাকসিন চালু হয়ে গেলে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসতে শুরু করবে। এই ভ্যাকসিন উৎপাদন থেকে শুরু করে এর বৈশ্বিক বিলিবণ্টন প্রক্রিয়া দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াবে।
এটি খুবই উৎসাহব্যঞ্জক বিষয়, করোনাভাইরাসের প্রথম ভ্যাকসিনটি উৎপাদিত হয়েছে তুর্কি বংশোদ্ভূত দুজন জার্মান নাগরিকের নেতৃত্বে পরিচালিত কোম্পানি বায়োএনটেক থেকে, যার তহবিল সরবরাহ করে থাকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অতি আনন্দের বিষয়, ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ ভুলে সবাই এখন ভ্যাকসিন তৈরি ও মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেওয়াকে আন্তর্জাতিকতাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছে। এটি অন্য বৈশ্বিক সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সবাইকে এক হতে উজ্জীবিত করবে।
তৃতীয় যে বিষয়টি আমাকে আশাবাদী করেছে সেটি হলো, করোনার কারণে জলবায়ুসংক্রান্ত আশাপ্রদ খবর পাওয়া যাচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, করোনাভাইরাসের চেয়ে জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক হতে পারে। কিন্তু চলতি বছরে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে ৭ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমেছে। এর মাধ্যমে আমরা অন্তত বুঝতে পারলাম, নির্গমন কমানো সম্ভব। আমরা এ–ও বুঝতে পারলাম, সরকারগুলো যখন কোনো সমস্যাকে সমস্যা হিসেবে স্বীকার করে, তখন সমাধানের জন্য সবাই এগিয়ে আসে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে যদি তারা করোনা সংকটের মতো একটি অতি বিধ্বংসী সমস্যা হিসেবে দেখে, তাহলে এ বিষয়ে সবাই এগিয়ে আসতে পারবে।
চতুর্থ আনন্দের বিষয় হলো, সরকারগুলোর ওপর জনগণের আস্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে। কোভিড–১৯ সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা জরুরি। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মহামন্দার পর অনেকে আশা করেছিল, বিরাজমান নব্য উদার রাজনীতি অর্থনীতিকে যথাসম্ভব সমাজতান্ত্রিক ধারায় নেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা ‘ধনীদের জন্য সমাজতন্ত্র এবং গরিবদের জন্য পুঁজিবাদ’ নীতি দেখলাম। অর্থাৎ বড় বড় কোম্পানিকে বড় বড় প্রণোদনা দেওয়া হলো আর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পথে বসে গেল। তবে এই মহামারির পর সরকারগুলোকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি জনকল্যাণমূলক ভূমিকা নিতে দেখা গেছে। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো সরকারগুলোকে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের সহায়তা করার জন্য চাপ দিয়েছে।
সর্বশেষ যে কারণে আমাদের আনন্দিত হতে হবে সেটি হলো, এই মহামারি বৈশ্বিক ব্যবস্থার পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছে। এই মহামারি বিশ্ববাসীকে রক্ষণশীল ও জনতুষ্টিবাদী সরকারব্যবস্থার কুফল সম্পর্কে একটি প্রচ্ছন্ন ধারণা দিতে পেরেছে।
এটি ঠিক যে বৈশ্বিক জনতুষ্টিবাদের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের পতনকে এখনই বিজয় বলা যাবে না। বাইডেনকে রিপাবলিকান প্রতিরোধের মুখে মেরুকরণ করা একটি দেশকে শাসন করতে গিয়ে সংগ্রাম করতে হবে। তবে তিনি যে সেই লড়াইয়ে সফল হবেন, সে বিষয়ে মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে।
সারা বিশ্বে সবার জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে গিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশগুলোকে সর্বোচ্চ মাত্রায় ব্যস্ত থাকতে হবে। এটি আগামী বছরের নভেম্বরে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠেয় জলবায়ু সম্মেলনের অ্যাজেন্ডাকেও ঘুরিয়ে দিতে পারে। মন্দার হুমকি এবং দেনার দায় নতুন করে বৈষম্যের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে সব সরকারকে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে।
তবে ২০২১ সালের উষালগ্নে মনে হচ্ছে কয়েক মাস আগে যে অবস্থা ছিল, তার চেয়ে বিশ্ব পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো। আর কিছু না হোক, নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর মতো আমাদের সামনে অন্তত পাঁচটি কারণ তো আছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
● মার্ক লিওনার্ড ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক