যে সিঙ্গাপুর করোনা প্রতিরোধের জন্য একসময় প্রশংসা পেয়েছিল, সেখানে এখন করোনার কারণেই অসাম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। অভিবাসী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সেই অসাম্য অনেকটা সহজেই চোখে পড়ছে। আজ শুক্রবার বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে জাকির হোসেন নামের একজনের কথা বলা হয়েছে, যিনি সিঙ্গাপুরে শ্রমিকদের থাকার জন্য বরাদ্দ ডরমিটরির একটি ঘরে ১১ জনের সঙ্গে থাকেন।
গত কয়েক সপ্তাহ জাকির হোসেন বাইরে যেতে পারেননি। বিবিসি অনলাইনে তিনি পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘দিনরাত একটি ঘরের মধ্যে আটকে রয়েছি। এটা আমাদের ওপর মানসিক নির্যাতন। এটা জেলখানার মতো। ঘরে স্থানস্বল্পতার কারণে সামাজিক দূরত্ব মানার সুযোগও নেই।’
কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থও হয়ে গেছেন জাকির হোসেন। যোগ দিয়েছেন কাজে। ভেবেছিলেন, সময় কেটে গেছে। তাঁর ডরমিটরি গত জুন মাসেই ভাইরাসমুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে গত মাস থেকে নতুন করে ডরমিটরিতে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে তাঁর মতো হাজারো অভিবাসী শ্রমিকের আবার কোয়ারেন্টিনে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
সিঙ্গাপুরে এখন স্থানীয় কমিউনিটিতে সংক্রমণ একক সংখ্যার ঘরে। মানুষ এখন কাজে ফিরছে, সিনেমা দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। রেস্তোরাঁগুলো থেকে আবার হাসির শব্দ আসছে। এর বিপরীত দিকে সিঙ্গাপুরে কম আয়ের লোকজনকে ঘরের ভেতরেই থাকতে হচ্ছে। তাঁদের ঘিরে ধরেছে অনিশ্চয়তা।
ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর গৃহীত পরিস্থিতি নিয়ে সিঙ্গাপুর প্রশংসা পেয়েছিল। কিন্তু অভিবাসী শ্রমিকদের ডরমিটরিতে ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে সিঙ্গাপুরের সাফল্য ম্লান হয়ে গেছে। সিঙ্গাপুরে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, সে বিষয়টি আরও আগে থেকে দেখা উচিত ছিল বলে মনে করছেন অধিকারকর্মীরা।
মাসখানেক হতে চলল সিঙ্গাপুরে এখন স্থানীয় কমিউনিটিতে সংক্রমণ একক সংখ্যার ঘরে। মানুষ এখন কাজে ফিরছে, সিনেমা দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। রেস্তোরাঁগুলো থেকে আবার হাসির শব্দ আসছে। এর বিপরীত দিকে সিঙ্গাপুরে কম আয়ের লোকজনকে ঘরের ভেতরেই থাকতে হচ্ছে। তাঁদের ঘিরে ধরেছে অনিশ্চয়তা।
বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, গত জানুয়ারি মাসে সিঙ্গাপুরে প্রথম বাইরে থেকে আসা এক ব্যক্তি করোনা শনাক্ত হয়। সপ্তাহখানেক পর শনাক্তের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায়। এরপরই দেশটিতে সংক্রমিত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা লোকজনকে শনাক্ত করতে ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া শুরু হয়। জাতীয় পর্যায়ে করোনা-ট্রেসিং অ্যাপ চালু হয়। জনগণের মধ্যে সতর্কতা বাড়ানোর পাশাপাশি যোগাযোগে স্বচ্ছতা আনা হয়। ওই সময় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক বিশেষজ্ঞরা সিঙ্গাপুরের পদ্ধতির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন বলেন, সম্পূর্ণ নিখুঁত শনাক্তপ্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ মান দেখিয়েছে সিঙ্গাপুর।
সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ ও ভারতের তিন লাখের বেশি স্বল্প আয়ের শ্রমিক কাজ করছেন। তাঁদের অধিকাংশই নির্মাণশিল্প ও উৎপাদনশিল্পের কর্মী হিসেবে সিঙ্গাপুরে রয়েছেন। সিঙ্গাপুরে এসব শ্রমিকের জীবনধারণ নির্ভর করে তাঁদের চাকরি ও অর্থের বিনিময়ে চাকরিদাতার দেওয়া থাকার জায়গার ওপর। তাঁরা একত্রে গাড়িতে করে নির্মাণকাজে যান এবং অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে একত্রে বিশ্রাম নেন। ভাইরাস ছড়ানোর জন্য আদর্শ জায়গায় তাঁদের থাকতে হয়।
একটি ডরমিটরিতে সর্বোচ্চ কতজন থাকবেন, এর কোনো আইনি সীমা নেই। কোভিড-১৯–এর আগে সাধারণত ২০ জনেরও বেশি শ্রমিক একত্রে ডরমিটরিতে থাকতেন।
গত মার্চে অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা গ্রুপ ট্রানসিয়েন্ট ওয়ার্কার্স কাউন্ট টু (টিডব্লিউসিটু) সতর্ক করে জানায়, নতুন ক্লাস্টার সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা অস্বীকার করা যায় না।
আংশিকভাবে জাতীয় লকডাউন দেওয়ার পর সাধারণ জনগণের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আসে। তবে অধিকারকর্মীদের আশঙ্কা সত্যি হয়। প্রতিদিন কয়েক শ শ্রমিকের করোনা শনাক্ত শুরু হয়। সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় জনগণ ও ডরমিটরিতে থাকা মানুষের মধ্য থেকে সংক্রমণের সংখ্যা প্রকাশ করা শুরু হয়।
নিউজিল্যান্ডের ম্যাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বিষয়ের অধ্যাপক মোহন দত্ত বলেন, ‘অন্য মহামারির মতো কোভিড-১৯ মহামারিও অসাম্যের। সিঙ্গাপুরে দুই ধরনের প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়টি তা আরও প্রকটভাবে তুলে ধরে।’
কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় যে ডরমিটরি পুরোপুরি বন্ধ করে রাখা হবে। এর মধ্যে থেকে ১০ হাজার স্বাস্থ্যবান কর্মীকে আলাদা করে ফেলা হয়। তাঁদের দিয়ে দেশটির প্রয়োজনীয় কাজ করাতে হবে। এর বাইরে অধিকাংশ শ্রমিক ডরমিটরিতে আটকে পড়েন। অনেককে ঘর থেকে বের হতেই দেওয়া হয়নি। এখান থেকে সংক্রমিত ব্যক্তিদের আলাদা করে ফেলা, সরানো ও চিকিৎসা করা হয়।
অন্য মহামারির মতো কোভিড-১৯ মহামারিও অসাম্যেরমোহন দত্ত , অধ্যাপক, নিউজিল্যান্ডের ম্যাসে বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ডরমিটরিতে সংক্রমণ ঠেকাতে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেয় সরকার। এর মধ্যে বিছানা পরিবর্তন ও এক জায়গায় লোকজন বেশি হলে তা সরিয়ে দেওয়ার মতো ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার জাকির হোসেনের মতো অনেকের ক্ষেত্রে এ সুবিধা মেলেনি। কোভিড-১৯–এ সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর জাকিরকে অস্থায়ী এক আবাসে রাখা হয়। পরে তাঁকে ফিরতে হয় ডরমিটরিতে। জাকির বলেন, ‘আমি যখন ১৭ এপ্রিল ডরমিটরি ছাড়ি এবং ৯ জুলাই ফিরে আসি, এর মধ্যে কোনো উন্নতি দেখিনি। ছয় মিটার বাই সাত মিটারের ঘরে ১২ জন থাকি।’
জাকির বলেন, ‘তারা আমাদের সামাজিক দূরত্ব মানতে বলে। আমাদের কাছে সামাজিক দূরত্ব কৌতুক ছাড়া কিছু নয়। এ ছোট্ট ঘরে সামাজিক দূরত্ব কীভাবে মানা যাবে? প্রতিটি ফ্লোরে এ রকম ১৫টি রুম আছে। ১৮০ জনের বেশি একই ফ্লোরে ভরা থাকেন। একই টয়লেট, বেসিন ও গোসলখানা ব্যবহার করেন। সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী, প্রতি ১৫ বেডের জন্য একটি টয়লেট, সিংক ও শাওয়ারের ব্যবস্থা থাকার কথা। তারা বাথরুম পরিষ্কার রাখতে বলে। কিন্তু তার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখেনি।’
অভিবাসী অধিকার সংস্থা ‘ইটস রেইনিং রেইনকোটস’–এর প্রতিষ্ঠাতা দীপা স্বামীনাথান বলেন, ‘জাকির হোসেনের মতো পরিস্থিতিতে অনেক অভিবাসী শ্রমিক দীর্ঘদিন ধরে রয়েছেন। আমরা এখন যে তাঁদের ডরমিটরি, খাবারের মতো পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছি, তা বহু বছর ধরেই রয়েছে। আমরা এত দিন এসব শুনিনি। কারণ, শ্রমিকেরা অভিযোগ করতে চান না। সিঙ্গাপুরে তাঁদের যা আছে, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চান তাঁরা। কোনো চাপের পরিস্থিতির মুখে যদি পড়েন, তবে তাঁরা পুরোপুরি ভেঙে পড়েন।’
করোনাভাইরাস মহামারি শ্রমিকদের ওপর যে চাপ তৈরি করছে, এতে অনেক দুঃখজনক ঘটনাও ঘটছে। অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টার মতো পথও বেছে নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
জাকির হোসেন বলেন, ‘তিনি তাঁর ডরমিটরিতে অনেক লোককে বলতে শুনেছেন যে তাঁরা আর পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারছেন না। তাঁরা বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করেন। বেতন পাওয়ার বিষয়টিও অনেক চাপ তৈরি করে। ঘরে আটকে থাকার কারণে অনেকে বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারেন না। বাড়িতে শ্রমিকের আয়ের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের কথা ভেবে অনেকেই কান্নাকাটি করতে থাকেন।
দেশটির জনশক্তিমন্ত্রী বিবিসিকে বলেন, বিদেশি যেসব শ্রমিক পূর্ণকালীন কাজে যুক্ত আছেন, তাঁদের অবশ্যই বেতন পরিশোধ করতে হবে। তবে যাঁরা কাজ করবেন না, তাঁদের জন্য বেতন দিতে বলাটা অযৌক্তিক হবে। তবে নিয়োগদাতারা যাতে উপযুক্ত বেতনব্যবস্থায় পারস্পরিক সম্মত হন, তা দেখা হবে।
সিঙ্গাপুর অভিবাসী শ্রমিকদের অবস্থার আরও উন্নতি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সরকার বলেছে, ২০২০ সালের মধ্যেই প্রত্যেক বাসিন্দা কমপক্ষে ৬ বর্গমিটারের থাকার জায়গা পাবেন। প্রতিটি রুমে ১০টি বেড থাকবে। প্রতিটি বেডের মধ্যে কমপক্ষে এক মিটার দূরত্ব থাকবে।