সংসদীয় গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষায় নজির গড়ল যুক্তরাজ্য

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এখন বেশ বিপাকে। ব্রেক্সিট ইস্যুতে তিনি নিজ দলের এমপিদের অনেকেরই সমর্থন পাচ্ছেন না। এরই মধ্যে গতকাল গিয়েছিলেন একটি গরুর খামারে। স্কটল্যান্ডের অ্যাবারডিনে। ছবি: এএফপি
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এখন বেশ বিপাকে। ব্রেক্সিট ইস্যুতে তিনি নিজ দলের এমপিদের অনেকেরই সমর্থন পাচ্ছেন না। এরই মধ্যে গতকাল গিয়েছিলেন একটি গরুর খামারে। স্কটল্যান্ডের অ্যাবারডিনে।  ছবি: এএফপি

মাদার অব অল পার্লামেন্টখ্যাত ব্রিটিশ পার্লামেন্ট তার সুনাম অক্ষুণ্ন রেখেছে। কর্তৃত্ববাদী নীতি অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন পার্লামেন্টের ক্ষমতা খর্ব করার যে চেষ্টা করেছিলেন, তা নাটকীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু, তা যে কতটা আত্মঘাতী হয়েছে, তা তিনি মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইন সংশোধনসহ তিনটি প্রস্তাবের ভোটাভুটিতে পার্লামেন্টে তিনি হেরেছেন, যা ব্রিটেনের ইতিহাসে অতীতে কখনো ঘটেনি। সংসদ পরিচালনায় সরকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বরিস সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন এবং নির্বাচন আয়োজনের জন্য আইন সংশোধনের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন।

গ্রীষ্মকালীন বিরতি শেষে সংসদ অধিবেশনে বসার পর প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা দেওয়ার সময় প্রথম চমক দেখেন যে তাঁর দলের একজন অপেক্ষাকৃত নবীন সদস্য তৃতীয় প্রধান বিরোধী দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটের সারিতে আসন নিয়েছেন। এটি ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর নিষ্ঠুরতম চমক। এরপর নিজ দলের বিদ্রোহী এবং বিরোধী দলগুলোর উত্থাপিত প্রস্তাব, যাতে পার্লামেন্ট পরিচালনার কর্তৃত্ব এমপিরা সরকারের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছেন। প্রস্তাবটি ২৯ ভোটের ব্যবধানে পাস হলে প্রকাশ পায় যে তাঁর দলে কত বড় ধরনের রক্তক্ষরণ ঘটতে যাচ্ছে। বিশ্বযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের পৌত্র স্যার নিকোলাস সোম, সাবেক মন্ত্রী কেনেথ ক্লার্ক, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ডোমিনিক গ্রিভ, সাবেক আইনমন্ত্রী ডেভিড গকসহ প্রায় দুই ডজন প্রবীণ নেতাকে দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়ার পরও তাঁরা পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও মর্যাদা রক্ষায় অনড় থাকেন। অতঃপর পাস হয় চুক্তিহীন বিচ্ছেদের বিরুদ্ধে এবং আলোচনার জন্য ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বাড়াতে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অনুরোধ জানানোর বাধ্যবাধকতা তৈরির আইন।

ওই আইনকে বরিস জনসন ইউরোপের কাছে ‘আত্মসমর্পণের দলিল’ এবং দেশের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে অভিহিত করে তা প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানালেও তাঁর আবেদন-নিবেদন-হুমকি কাজে আসেনি। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ব্রেক্সিট ‘করব অথবা মরব’—এই পণ বাস্তবায়নের আশা এভাবে ধূলিসাৎ হতে চলেছে দেখে তাঁর শেষ চেষ্টা ছিল ১৫ অক্টোবর আগাম নির্বাচন আয়োজন করা, যাতে ব্রেক্সিট ইস্যুতে ম্যান্ডেট নবায়নের সুযোগ তৈরি হয়। জনমতগুলোতে এগিয়ে থাকার সুবাদে তাঁর আশা, তিনি অক্টোবরে নির্বাচন করতে পারলে তাঁর ঘোষিত সময়সীমার মধ্যেই ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন সম্ভব। কিন্তু ব্রিটেনের নির্ধারিত মেয়াদের পার্লামেন্টবিষয়ক আইনে আগাম নির্বাচনের জন্য আইন সংশোধন প্রয়োজন, যা সংশোধনে দুই–তৃতীয়াংশের সমর্থন দরকার হয়। বিরোধীরা রাজি না হওয়ায় এবং ভোটদানে বিরত থাকায় ওই সংশোধনীর চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। এরপর বরিস বৃহস্পতিবার ঘুম থেকে উঠে জেনেছেন, তাঁর আপন সহোদর পরিবারের প্রতি আস্থার চেয়ে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে সরকার থেকে বিদায় নিয়েছেন।

ইউরোপের সঙ্গে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ কার্যকর করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টের যাচাই-বাছাই এবং বিতর্ক এড়াতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। সে কারণে গত আগস্টের মাঝামাঝি তিনি সিদ্ধান্ত নেন, সেপ্টেম্বরে পার্লামেন্ট অধিবেশনের সময় কমিয়ে দিয়ে পাঁচ সপ্তাহের জন্য তা বন্ধ রাখবেন। দায়িত্বভার গ্রহণের পর সরকারের নীতি-পরিকল্পনা তুলে ধরার জন্য রানির ভাষণ দেওয়ার যে রীতি প্রচলিত আছে, তার ব্যবস্থা করতেই অধিবেশন বসবে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে। রাজনীতিক ও গণমাধ্যম তাঁর এই কৌশলকে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল বা ক্যু অভিহিত করেছিল। সেই ক্যু ব্যর্থ হয়েছে। পার্লামেন্ট তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। বিবদমান বিরোধীদের ঐক্য এবং ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির ডজন দুয়েক প্রবীণ আর অভিজ্ঞ এমপির দলীয় সংকীর্ণতার বাইরে এসে গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ানোয় তা সম্ভব হয়েছে।

পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রগুলোতে সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে বিরোধী দল নির্বাচনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, এমন নজির বিরল। ব্রিটেনে এখন তা–ই ঘটছে। অথচ প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টি দুই বছর ধরেই বলে আসছিল, ব্রেক্সিট চুক্তির প্রশ্নে অচলাবস্থা নিরসনের উপায় হচ্ছে সাধারণ নির্বাচন। যদিও এখানে ঘটছে তার উল্টো।

প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জানিয়েছেন, সোমবার তিনি নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করে প্রস্তাব পাসের মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের পথে এগোবেন। প্রস্তাব পাসের ক্ষেত্রে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট হবে। কিন্তু বিরোধী সদস্যরা জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা এ প্রস্তাবে সমর্থন দেবেন না। তাঁরা আগে চান, বিচ্ছেদের সময়সীমা বাড়ানো নিশ্চিত হোক। সুতরাং, বিরোধীরা বলছেন, সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে সময়সীমা বাড়ানোর অনুরোধ জানানোর পর তার ফয়সালা হলেই তাঁরা নির্বাচনে রাজি হবেন।

এখানে বিরোধী দলের কৌশল খুবই স্পষ্ট। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীকে তারা কোনো সুযোগ দেবে না। সুতরাং তিনি সুবিধা পেতে পারেন এমন সময় এবং পরিবেশে কোনো নির্বাচন নয়। এ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। প্রধানমন্ত্রী কার্যত ক্ষমতাহীন। কিন্তু ম্যান্ডেট নবায়নের কোনো সুযোগও তিনি পাচ্ছেন না। তাহলে কি তিনি ব্রেক্সিটের মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ জানাবেন? তার উত্তরও বৃহস্পতিবার তিনি দিয়েছেন, ‘আমি খাদের মধ্যে পড়ে মারা যাব, তবু মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ করব না।’ তাহলে তাঁর সামনে বিকল্প কী? পদত্যাগ? মি. বরিস পদত্যাগ করলে ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির অন্য কোনো নেতা তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচিত হতে পারবেন, এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। বিশেষ করে, তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ প্রায় অসম্ভব।

বিকল্প হিসেবে কি বিরোধী নেতা জেরেমি করবিন প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন? গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে সেটাই হওয়ার কথা। কিন্তু পুঁজিবাদী গণতন্ত্র যুক্তরাজ্যের বিরোধীদলীয় নেতা হলেন মার্ক্সবাদী ও শান্তিবাদী বামপন্থী জেরেমি করবিন। শিল্পপতি ও পুঁজির মালিকেরা করবিন-আতঙ্কে ভুগছেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বহুবার বলেছেন, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর আসনে মি. করবিনকে বসতে দেবেন না। বিনিয়োগ বাজারের পত্রিকা সিটিএএম–এর এক সম্পাদকীয়তে বুধবার লেখা হয়েছে, করবিন প্রধানমন্ত্রী হলে অর্থনীতির যে ক্ষতি হবে, তা চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিটের ক্ষতির চেয়েও বেশি। অথচ সরকারি সমীক্ষায় চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিটের কারণে খাদ্য, জ্বালানি, জরুরি ওষুধসহ চিকিৎসাসামগ্রীর সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। একজন শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসক প্রাণহানির আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। রাজনীতির অঙ্গনে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন, তাঁরা করবিনকে এই পদে সমর্থন দেবেন না। লেবার পার্টির ডানঘেঁষা-মধ্যপন্থীদের কয়েকজন তাঁকে কখনোই নেতা মানতে চাননি। ফলে করবিনের পক্ষে আস্থা ভোটে জয়ী হওয়া কঠিন। লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কাউকে বেছে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু সর্বজনগ্রাহ্য ব্যক্তি পাওয়াটা কঠিন। বলে রাখা ভালো, অনেক অসম্ভবই ইতিমধ্যে সম্ভব হয়েছে। আর বিরোধী নেতা হিসেবে জেরেমি করবিন এরই মধ্যে দুজন প্রধানমন্ত্রীকে (ডেভিড ক্যামেরন ও থেরেসা মে) বিদায় জানিয়ে তৃতীয়জনের বিদায়ের অপেক্ষায় আছেন।

ব্রিটিশ রাজনীতির আধুনিক ইতিহাসে এত বড় সংকট আর আসেনি। তবে এই সংকটের মধ্যেও ওয়েস্টমিনস্টার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, পার্লামেন্টের প্রাধান্য প্রমাণিত হয়েছে। কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিকের উত্থান আপাতত পরাস্ত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে নির্বাচিত রাজনীতিকদের কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার প্রবণতার বিপরীতে এ এক উদ্দীপনাময় সাফল্য।