শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি যেভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল

বৈদেশিক মুদ্রাসংকটের কারণে শ্রীলঙ্কায় নিত্যপণ্যের ভয়াবহ সংকট দেখা দেয়
রয়টার্সের ফাইল ছবি

ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট পার করছে শ্রীলঙ্কা। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতার পর থেকে এমন সংকটে আগে পড়েনি দ্বীপরাষ্ট্রটি। কয়েক মাসের টানা লোডশেডিং ও ভয়াবহ খাদ্যসংকট, জ্বালানি ও ওষুধের সংকট সাধারণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেছে। ফল, দেশটিতে সরকার পতনের আন্দোলন চলতি সপ্তাহে শেষ পর্যন্ত সহিংস রূপ নেয়।

বার্তা সংস্থা এএফপি দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশটির অর্থনৈতিক সংকটের মূলে গিয়ে বিশ্লেষণ করেছে।

শ্বেতহস্তী

চীনের ঋণে শ্রীলঙ্কা বেশ কটি বিতর্কিত অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প শুরু করে, যা এর মধ্যেই তাদের ঋণের বোঝা আরও বাড়িয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গলার কাঁটা হিসেবে দেখা দেয় দক্ষিণের হাম্বানটোটা জেলার বড় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর। এই প্রকল্প শুরুর পর থেকেই লোকসান দিয়ে আসছে দেশটি।

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছেন

এই সমুদ্রবন্দরের মতো চীনা প্রকল্পের লোকসানের আরও নমুনা আছে—যেমন কলম্বোয় বিরাট কনফারেন্স সেন্টার, যা চালু হওয়ার পর থেকেই অব্যবহৃত আছে। এ ছাড়া আছে ২০ কোটি ডলার খরচে তৈরি বিমানবন্দর। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে বিমানবন্দরটি বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার মতো আয়ও করতে পারছিল না!

প্রকল্পগুলো গতি পেয়েছিল রাজাপক্ষে পরিবারের হাত ধরেই। পরিবারটি দুই দশক ধরে শ্রীলঙ্কায় প্রভাব বিস্তার করে আসছে।

টেকসই কর কমানো

২০১৯ সালে ইস্টার সানডেতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর পুরো দেশ যখন টালমাটাল, তখন অর্থনৈতিক স্বস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এরপর তিনি যে কাজটি করেন, তা বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য অনেকটা দায়ী। তিনি শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কর সংকোচন নীতি ঘোষণা করেন। এই সিদ্ধান্ত বাজেট ঘাটতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যায়।

মহামারির প্রাদুর্ভাব

ট্যাক্স কাটছাঁটের কয়েক মাস পরেই বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। ফলে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা শূন্যে নেমে আসে, প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের রেমিট্যান্সও কমে যায়। মূলত ঋণ পরিশোধের জন্য সরকার এই বড় দুই আয়ের উৎসের ওপর নির্ভর করেছিল।

সার আমদানি নিষিদ্ধ

শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার মজুত যখন আশঙ্কাজনক হারে কমছিল, তখনই এমন এক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা দেশটির জন্য আত্মঘাতী হয়ে আসে। ২০২১ সালে ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত কয়েকটি সার ও কৃষি রাসায়নিক আমদানি নিষিদ্ধ করে। শ্রীলঙ্কা সরকার দেশকে বিশ্বের প্রথম অরগানিক কৃষিনির্ভর দেশে পরিণত করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। বিভিন্ন কৃষিপণ্য বিশেষত অন্যতম রপ্তানি পণ্য চায়ের উৎপাদন কমে যায়।

বিভিন্ন পণ্যের স্বল্পতা

গোতাবায়া ক্ষমতা নেওয়ার দুই বছরের মধ্যে ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন হয়। ফলে পণ্য আমদানি করতে ব্যবসায়ীরা বিদেশি মুদ্রা জোগাড় করতে হিমশিম খান। গুঁড়া দুধ, চিনি, চাল, ডালের মতো প্রয়োজনীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট দেখা দেয়, গ্যাসস্টেশনে পেট্রল, কেরোসিন উধাও হয়ে যায়। তেল কিনতে মানুষের লম্বা লাইন দেখা যায়। সঙ্গে যোগ হয় ভয়াবহ লোডশেডিং।

ঋণ ও খেলাপি

গত এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন প্রধান নিয়োগ দেন। ওই নিয়োগের পর শ্রীলঙ্কা ৫১ বিলিয়ন বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অপারগতা ঘোষণা করে। কারণ, তারা অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা জমা রাখবে। কিন্তু এই পদক্ষেপ শ্রীলঙ্কার ক্ষয়িষ্ণু অর্থের ঘাটতি পূরণে ব্যর্থ হয়।

চলতি মে মাসের শুরুতে দেশটির ব্যবহারযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা ছিল মাত্র ৫০ মিলিয়ন। দেশটি এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সহায়তা (বেল আউট তহবিল) নিয়ে আলোচনা করছে। গত সোমবার টানা বিক্ষোভের পর প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান নন্দলাল উইরাসিংহে বুধবার বলেছেন, নতুন সরকার দ্রুত ক্ষমতা না নিলে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ধস আসন্ন। এই পর্যায়ে শ্রীলঙ্কার বিপর্যয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।