রাজনীতিবিদদের কাছে আসলে জনগণ কারা?

রাজনীতিবিদেরা নিজেদের যেকোনো কর্মকাণ্ডে জনগণের দোহাই দেন। রাজনীতিতে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা পালন করে রাজনীতিবিদেরা। সেই হিসেবে জনগণের দোহাই দেওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু এই জনগণ কি আদতেই দেশের সাধারণ জনতা? নাকি স্রেফ নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যই জনগণের পিঠে সওয়ার হন রাজনীতিবিদেরা?

গণতন্ত্র, জনগণতন্ত্র, বাক্‌স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা—আজকের বৈশ্বিক রাজনীতিতে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। বিশ্বব্যাপী বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই শাসক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এসব শব্দ উচ্চারণ করে রাজনৈতিক খেলা চালু রাখেন। এক পক্ষের দাবি, তাদের আমলে এসব পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর বিরোধী পক্ষ বলে থাকে, দেশ ‘রসাতলে’ যাচ্ছে গণতন্ত্র-ব্যক্তিস্বাধীনতার অভাবেই। দুই পক্ষই এ ক্ষেত্রে সাক্ষী মানে জনগণকে। কিন্তু সেই সাক্ষীগোপাল ‘জনগণ’-এর বাস্তব রূপ কখনো চোখে দেখা যায় না।

ব্রিটিশ সাময়িকী দা ইকোনমিস্টের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, বর্তমান বিশ্বে লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির প্রসার ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ইউরোপ-আমেরিকার যেসব দেশ ‘গণতন্ত্র, গণতন্ত্র’ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে, সেসব দেশেও এখন মন ভুলানো কথা বলা তথাকথিত ‘জনপ্রিয়’ নেতা-নেত্রীদের জয়জয়কার দেখা যাচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প বা বরিস জনসনের মতো এসব রাজনীতিবিদেরা নিজেদের বক্তব্যকে ‘জনগণের চাওয়া’ বলে প্রচার করে থাকেন। ঠিক এই জায়গাতেই সমস্যা। এসব লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতিবিদ আদতে নিজেদের পথ মসৃণ করতে ও ব্যক্তিগত চাওয়া পূরণের জন্যই জনগণের ঘাড়ে পা রাখেন। অথচ যে জনগণের কথা বলে সব জায়েজ করা হচ্ছে, সেই জনতাই এসব বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকে না। এক হিসেবে, এই রাজনীতিবিদেরা তাদের শত্রুদের নিকেশ করতে নিজেদের মত জনগণের বলে চালিয়ে দেন।

জনগণের কথা বলেই ভারতে একটি ‘মৌলিক সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর’ কথা বলে শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। জনগণের চাওয়াকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেই ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদ করা হয়। চীনে আবার মুসলিম উইঘুরদের নাগরিক অধিকার ‘সীমিত’ করা হয়েছে জনগণ ও রাষ্ট্রের কল্যাণের দোহাই দিয়ে। একইভাবে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। আর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সেই জনগণের কথা বলেই স্থগিত করে দেন পার্লামেন্টের কার্যক্রম।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

সাধারণত লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতিবিদেরা নিজেদের পথের কাঁটা দূর করতেই জনগণকে ব্যবহার করে থাকেন। বিশেষ করে আইনসভা, আদালত ও সংবাদমাধ্যমকে আটকানোর জন্য ‘জনগণ চায়’-এই শব্দবন্ধটি ভালো কাজে দেয়। দেশ, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র-সবকিছুর মূল হচ্ছে জনগণ। গণতন্ত্রে বলা হয়ে থাকে, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। তাই সেই জনগণের ক্ষমতাকে যদি হাতিয়ার বানানো যায়, তবে সেই ক্ষমতা হয় নিরঙ্কুশ। আর প্রশ্নাতীত আধিপত্য কে না চায়!

মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাডোর। ছবি: রয়টার্স

সুতরাং যখন আইনসভা, আদালত ও সংবাদমাধ্যমকে ঠেকানোর প্রয়োজন হয় তখন লোকরঞ্জনবাদী নেতারা জনগণকে টেনে আনেন। ওই নেতাদের বিরোধীরা তখন হয়ে যায় ‘জনগণের শত্রু’, ‘জাতির শত্রু’। এই কারণেই সংবাদমাধ্যমকে ‘জনগণের শত্রু’ বলে অভিহিত করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই প্রবণতা কোনো তন্ত্র মানে না, গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র সবই এক হয়ে যায়। মেক্সিকোর নতুন সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাডোর তাই সাংবাদিকদের সতর্ক করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে বলে দেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে, আপনারা শুধু ভালো সাংবাদিকই নন, আপনারা একই সঙ্গে বিচক্ষণও...এবং আপনারা যদি সীমা অতিক্রম করেন, ভালোভাবেই কিন্তু জানেন তখন কি হতে পারে, তাই না? কিন্তু এটি আমি নই, এরা জনগণ।’ অবশ্য ওব্রাডোর স্পষ্ট করে বলেননি জনগণ কি করতে পারে। তবে মেক্সিকোর সাংবাদিকেরা তা আঁচ করতে পারেন এক পরিসংখ্যান দিয়ে। তাতে জানা যায়, চলতি বছরে মেক্সিকোতে খুন হয়েছেন ১২ জন সাংবাদিক।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ছবি: রয়টার্স

অবশ্য এমন রাজনীতিবিদদের উত্থানে সাধারণ জনতারও দায় আছে। তারাই তো গালভরা বুলিতে ভুলে থলে ভরে ভোট দিয়েছেন। আর সেই শক্তিতে বলীয়ান হয়েই ট্রাম্প-জনসনেরা নিজেদের বিরোধী পক্ষকে দেশের মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। আবার জনগণের নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় ভাগ বসিয়ে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও চালাচ্ছেন তাঁরা। দিন শেষে এ ধরনের রাজনীতিবিদেরা নিজেদের পথ নিষ্কণ্টক করতে ক্ষমতাদাতা জনতাকে বলি দিতেও দ্বিধাবোধ করেন না।

তাই রাজনৈতিক বক্তৃতার মঞ্চ থেকে যখন ‘জনগণ’ শব্দটি ভোটারদের কানে ভেসে আসবে, তখন সেই সাধারণ জনতার সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে। বুঝে নিতে হবে যে-কথায় কথায় সাধারণ জনতার দোহাই যারা দিচ্ছেন, তারা আদতে গণতন্ত্রী নন। বরং গণতন্ত্রের আড়ালে নিজেদের আসন পাকাপোক্ত করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।