প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ছিল ভয়াবহ। সামরিক-বেসামরিক মিলিয়ে ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ হতাহত হয়। চার বছর ধরে চলা এই যুদ্ধ মানবতার জন্য ভীষণ পীড়াদায়ক ছিল। তবে এই সময়েই চিকিৎসার নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়।
দ্য ইনকোয়ারারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দুই বছরে চিকিৎসকদের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে অনেকেই মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান। যুদ্ধ শেষে ৭ লাখ ৩৫ হাজার ৪৮৭ ব্রিটিশ সেনা বড় ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পান। তাঁদের বেশির ভাগই শেল বিস্ফোরণে আহত হয়েছিলেন। বিশ্বযুদ্ধে অনেকে মুখে আঘাত পান। ১৬ শতাংশের আঘাত ছিল গুরুতর। মুখের আঘাতের চিকিৎসায় আগে খুব বেশি কিছু করার ছিল না। যাঁদের মুখে আঘাত লেগেছিল, তাঁদের দেখতে বীভৎস লাগত। তাঁদের দেখতে, শ্বাস নিতে ও খেতে নানা সমস্যা হতো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিউজিল্যান্ডের হ্যারল্ড গিলিস নামের এক তরুণ ইএনটি (ইয়ার, নোজ ও থ্রোট) সার্জন মুখে আঘাত পাওয়া ব্যক্তিদের চিকিৎসায় প্রচেষ্টা শুরু করেন। তাঁর মনে হয়, এ ক্ষেত্রে বিশেষ কাজ করার প্রয়োজন আছে। সময়টাও তাঁর পক্ষে ছিল। সামরিক মেডিকেল নেতৃত্বও এই ধরনের আঘাত বা ক্ষত চিকিৎসায় বিশেষ সেন্টার স্থাপনের গুরুত্ব বুঝতে পারে।
১৯১৬ সালের জানুয়ারিতে গিলিসকে মুখের আঘাত চিকিৎসায় কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়। অ্যাল্ডারসটে কেমব্রিজ মিলিটারি হাসপাতালে ব্রিটেনের প্রথম প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট স্থাপন করা হয়। গিলিস ভাবছিলেন, শ দুয়েক রোগী আসতে পারে। কিন্তু শুরুতেই দুই হাজারের বেশি রোগী চলে আসে। এর বাইরে মুখ পুড়ে যাওয়া নাবিক ও বিমানসেনাদের চিকিৎসা দিতে হয় তাঁকে।
গিলিস তাঁর উদ্ভাবিত প্লাস্টিক সার্জারিকে ‘অদ্ভুত নতুন শিল্পকর্ম’ বলে উল্লেখ করেন। পরীক্ষা ও প্রয়োগ পর্যায়ে আরও নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন তিনি। অবশ্য এ ধরনের কিছু পদ্ধতি আগে ভারতে ব্যবহৃত হচ্ছিল। তবে গিলিসের উদ্ভাবন করা একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হলো টিউব পেডিকল স্কিন গ্রাফটিং। এতে টিউব পদ্ধতিতে শরীরের কোনো অংশ থেকে চামড়া নিয়ে তা ক্ষতস্থানে প্রতিস্থাপন করা হয়।
প্লাস্টিক সার্জারির ক্ষেত্রে গিলিসের হাতে প্রথম রোগী হিসেবে আসেন ওয়াল্টার ইও নামের এক ওয়ারেন্ট অফিসার। ১৯১৬ সালে জুটল্যান্ড যুদ্ধে মুখে আঘাত পেয়েছিলেন তিনি। এতে তাঁর চোখের পাতাসহ মুখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাঁর মুখে স্ক্রিন গ্রাফটিং করা হয়। চোখে পাতাও বসানো হয়। তবে এর ফল একেবারে নিখুঁত ছিল না। এই পদ্ধতি আরও অনেক রোগীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন গিলিস।
অস্ত্রোপচার ও পরবর্তী চিকিৎসা চালিয়ে যেতে আরও বড় জায়গার দরকার ছিল গিলিসের। গিলিস তখন লন্ডনের কুইন ম্যারি হাসপাতালে বিশেষ ইউনিটের নকশা করেন। সেখানে ৩২০টি বেড ছিল। বছর শেষে সেখানে ৬০০ বেড দাঁড়ায়। মোট ১১ হাজার ৭৫২টি অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। যুদ্ধ শেষে সেই ইউনিটে ১৯২০ থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে আট হাজারের বেশি সামরিক ব্যক্তি চিকিৎসা নেন। ১৯২৯ সালে ইউনিটটি বন্ধ হয়ে যায়।
গিলিস গলফ খেলোয়াড় ও হাস্যরসিক হিসেবে পরিচিত হলেও ১৯১৪ সালের আগ পর্যন্ত খুব বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেননি। যখন যুদ্ধ শুরু হলো, তখন তাঁর বয়স ৩২ বছর। এ সময় তিনি রয়েল আর্মি মেডিকেল করপোরেশনে যোগ দেন। ইউমেরাক্সে ৮৩ ডাবলিন হাসপাতালে পাঠানো হয় তাঁকে। সেখানে তিনি চার্লস ভালাদিয়ার নামের এক দন্ত চিকিৎসকের তদারকে ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিকদের ত্বক ও হাড়ের চিকিৎসা নিয়ে কাজ করছিলেন চার্লস।
‘ব্যাটল অব সোম’নামে পরিচিত যুদ্ধে অনেকেই মুখে আঘাত পান। পারস্যের চিকিৎসকদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে গিলিস বিশেষ প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট তৈরির পক্ষে কথা বলেন। ওই সময় অনেকেই তাঁকে প্রচলিত সিনথেটিক উপাদান ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তবে গিলিস তাঁর স্কিন গ্রাফটিং ব্যবহারের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তিনি তাঁর উদ্ভাবনের নাম দেন টিউব পেডিকেল। এটাই পরে রিকনস্ট্রাকশন সার্জারির মৌলিক কৌশল হয়ে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পাশাপাশি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এই পদ্ধতি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
গিলিস তাঁর কাজের জন্য প্লাস্টিক সার্জারির জনক বলে পরিচিতি পান। ১৯৩০ সালে নাইটহুড উপাধি পান তিনি।