‘মাফিয়া বসের’ মতো আচরণ করছেন ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের দুই সিনেট আসনের পুনর্নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত ৫ ডিসেম্বর জর্জিয়ার ভালডোস্টা শহরে ভালডোস্টা রেজিওনাল এয়ারপোর্টে
ফাইল ছবি: এএফপি

ক্ষমতায় টিকে থাকতে ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জোর করে ভোটের হিসাব পাল্টে দেওয়া থেকে শুরু করে সামরিক শক্তি ব্যবহারের হুমকি পর্যন্ত দিতে দ্বিধা করছেন না। তাঁর এই আচরণে অভাবিত হুমকির মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের অবশিষ্ট দুটি আসনে পুনর্নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হবে আজ মঙ্গলবার। এই দুই আসনে দুই রিপাবলিকান প্রার্থী ডেভিড পারডু ও কেলি লফলারের বিরুদ্ধে লড়ছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির জন আসফ ও রেভারেন্ড রাফায়েল ওয়ারনক। ইতিমধ্যে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ আগাম ভোট দিয়েছেন। সর্বশেষ জনমত জরিপে আসফ ও ওয়ারনক গড়ে ২ শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে। এই নির্বাচনেই নির্ধারিত হবে মার্কিন সিনেটের নিয়ন্ত্রণ কোন দলের কাছে যাবে। চূড়ান্ত ফলাফল জানতে অবশ্য কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।

আগামীকাল বুধবার, অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি, মার্কিন কংগ্রেসের উভয় কক্ষ এক যৌথ অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের হিসাব চূড়ান্ত করবে। এরপর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে, কে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ওই সভার সভাপতি। কাজেই তাঁকেই এই ঘোষণা দিতে হবে। চূড়ান্ত ফলাফল অবশ্য আগেই জানা, ৩০৬ ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঝুলিতে জমা পড়েছে ২৩২ ভোট। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে একজন প্রার্থীকে ন্যূনতম ২৭০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

জর্জিয়ার ওই দুই আসনের পুনর্নির্বাচন কেবলই নিয়মমাফিক। মার্কিন কংগ্রেসে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট গণনা করে আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণাও অনুষ্ঠানসর্বস্ব। তারপরও এই দুই আয়োজন মহা উত্তেজনাপূর্ণ নাটকের রূপ নিয়েছে। কারণ একটাই—প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। নির্বাচনে বাইডেনের চেয়ে ৭০ লাখ কম ভোট পেয়েও তিনি পরাজয় মানতে নারাজ। তাঁর অভিযোগ, ভোটে কারচুপি হয়েছে। কাঁড়ি কাঁড়ি ভোট পেছন দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে ভোট বাক্স ভরে ফেলা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিতর্কিত অঙ্গরাজ্যগুলোয় একাধিকবার ভোট গণনা করা হয়েছে। জর্জিয়ায় পুরো ৫০ লাখ ভোট হাতে গোনা হয়েছে। কারচুপির অভিযোগ নিয়ে ট্রাম্প আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন, ৬০টির বেশি মামলা করেছেন। কিন্তু সব কটি মামলায়ই তাঁকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। এমনকি সুপ্রিম কোর্ট থেকেও কোনো আশ্বাস পাননি তিনি।

এখন ট্রাম্পের শেষ ভরসা বুধবারের ইলেকটোরাল কলেজ ভোট গণনা। ট্রাম্পের উৎসাহ পেয়ে ১৫০ জনের মতো রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য ও ১২ জন সিনেটর ইলেকটোরাল ভোটের হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণার পরিবর্তে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তদন্তে অবিলম্বে একটি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন।

এখানেই শেষ নয়। এক দিন আগে জর্জিয়ার সেক্রেটারি অব স্টেট ব্রাড র‍্যাফেন্সবার্গারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময় ট্রাম্প সরাসরি দাবি করেন, যে ১১ হাজার ৭৮০ ভোটে তিনি ওই অঙ্গরাজ্যে পরাজিত হয়েছেন, তা যেন ‘খুঁজে’ বের করে তাঁকে বিজয়ী হতে সাহায্য করা হয়। অন্য কথায়, তিনি এই সংখ্যক ভোট না পেলেও র‍্যাফেন্সবার্গারকে ওই ভোটগুলো পাইয়ে দেওয়ার আবদার করেছেন। ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, তাঁর কথা না শুনলে র‍্যাফেন্সবার্গার ও তাঁর আইনজীবীকে বিপদে পড়তে হবে। তবে র‍্যাফেন্সবার্গার স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, ‘প্রেসিডেন্ট, আপনি ভুল বলছেন। ভোটে কোনো কারচুপি হয়নি।’

‘মাফিয়া বস’ ট্রাম্প

জর্জিয়ার সেক্রেটারি অব স্টেটের সঙ্গে ট্রাম্প যে আচরণ করেছেন, তার সঙ্গে মাফিয়া বসের আচরণের মিল খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। নির্বাচনী কাজে হস্তক্ষেপ শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এই যুক্তিতে বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন বলেও মনে করছেন অনেকে। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কুকর্ম ফাঁস করে দিয়েছিলেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক কার্ল বার্নস্টাইন। তিনি বলেছেন, নিক্সনও এমন দুর্বৃত্তের মতো আচরণ করেননি।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী উইলিয়াম কোহেন বলেছেন, ‘বিশ্বের সামনে আমেরিকার মাথা কাটা গেল। এখন আমরা কোন সাহসে অন্য দেশকে নির্বাচনে কারচুপি বা অগণতান্ত্রিক আচরণের জন্য দুষব। সে নৈতিক যোগ্যতা আমরা হারিয়েছি।’

ক্ষমতায় টিকে থাকতে ট্রাম্প সামরিক আইন জারির কথা পর্যন্ত ভেবেছেন। সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনিসহ মোট ১০ জন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিতে টেনে আনার তেমন কোনো চেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় সাবধান করে দিয়েছেন। তাঁরা ট্রাম্পকে পরামর্শ দিয়েছেন, ‘নির্বাচন শেষ, এবার সামনে আগাও।’

বিশ্বের সামনে আমেরিকার মাথা কাটা গেল। এখন আমরা কোন সাহসে অন্য দেশকে নির্বাচনে কারচুপি বা অগণতান্ত্রিক আচরণের জন্য দুষব। সে নৈতিক যোগ্যতা আমরা হারিয়েছি।
উইলিয়াম কোহেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী

কিন্তু সমস্যা তো একা ট্রাম্পকে নিয়ে নয়, মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকান পার্টির শীর্ষস্থানীয় ১৫০ জন সদস্য তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। সিনেটর টেড ক্রুজ এবং সিনেটর জশ হলি জানিয়েছেন, তাঁরা ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসে ইলেকটোরাল কলেজ সত্যয়নে বিরোধিতা করবেন। এই বিরোধিতার ফলাফল শূন্য, সে কথা জেনেও তাঁরা এই অর্থহীন নাটক করবেন শুধু ট্রাম্পকে খুশি করতে। এই দুই নেতা ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হওয়ার প্রত্যাশী।

ট্রাম্পের পক্ষে লড়ছেন, এই কথা বলে টেড ক্রুজ ও জশ হলি ইতিমধ্যে চাঁদা তোলা সংগ্রহ করে দিয়েছেন। ট্রাম্প নিজেও ২৫ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি চাঁদা সংগ্রহ করেছেন। টেড ক্রুজ যুক্তি দেখিয়েছেন, নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেওয়া তাঁর লক্ষ্য নয়। তিনি শুধু নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়মের ব্যাপারটা তুলে ধরতে চান। সে কথার জবাবে সিনেটে ডেমোক্র্যাট নেতা চাক শুমার বলেছেন, ‘অনিয়ম তদন্ত করতে চান, ভালো কথা। টেলিফোনে ট্রাম্পের হুমকি নিয়ে তদন্ত করুন।’

আঁধারে আলো

আশার কথা হলো, ট্রাম্প ও টেড ক্রুজদের তৎপরতার সঙ্গে সব রিপাবলিকান নেতা হাত মেলাননি। সিনেটে রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেল ইতিমধ্যে জো বাইডেনকে বিজয়ী হিসেবে মেনে নিয়েছেন। তিনি নিজ দলের সিনেটরদের ইলেকটোরাল ভোট নিয়ে প্রতিবাদে যোগ না দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন। মিট রমনি, সুসান কলিন্সসহ ১০ জন মধ্যপন্থী রিপাবলিকান সিনেটর জর্জিয়ার নির্বাচন পেছন দরজা দিয়ে জয়ের চেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পেনসিলভানিয়ার সিনেটর প্যাট টুমি বলেছেন, অনিয়মের অভিযোগ তুললেই তো হবে না, তার প্রমাণ চাই। কোথায় সেই প্রমাণ?

সবচেয়ে বড় কথা, ট্রাম্পের চাপ সত্ত্বেও রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত একাধিক অঙ্গরাজ্যের নির্বাচন কর্মকর্তারাও নতি স্বীকার করেননি। যেমন জর্জিয়ার গভর্নর ও সেক্রেটারি অব স্টেট। ট্রাম্প তাঁদের দুজনকেই বলেছেন, আগামী নির্বাচনে তাঁরা যাতে পরাস্ত হন, তা তিনি নিশ্চিত করবেন। আদালতের সিদ্ধান্ত থেকেও স্পষ্ট বার্তা এসেছে, ট্রাম্প সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন বিচারপতিকে মনোনয়ন দিলেও তাঁরা তাঁকে বেআইনি কাজে কোনো রকম মদদ দেবেন না।

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের অবশিষ্ট দুটি আসনে পুনর্নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হবে আজ মঙ্গলবার। এই দুই আসনে দুই রিপাবলিকান প্রার্থী ডেভিড পারডু ও কেলি লফলারের বিরুদ্ধে লড়ছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির জন আসফ ও রেভারেন্ড রাফায়েল ওয়ারনক।

কোনো কোনো ভাষ্যকার মনে করেন, ট্রাম্প যেভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পদদলিত করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চাইছেন, তাতে অচিরেই রিপাবলিকান পার্টি বিভক্ত হয়ে পড়বে। ওয়াশিংটন পোস্ট–এর জেনিফার রুবেন মন্তব্য করেছেন, এই দল এরই মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদিকে রয়েছে টেড ক্রুজ ও জশ হলির মতো রাজনীতিকেরা, যাঁরা ব্যক্তিস্বার্থ সামনে এনে দেশের স্বার্থ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন। সংখ্যায় অল্প হলেও অন্যদিকে রয়েছেন নীতিজ্ঞানসম্পন্ন রাজনীতিক, যাঁদের কাছে দেশের স্বার্থ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

জর্জিয়ার পুনর্নির্বাচন

‘নির্বাচনে ভোট চুরি হয়েছে’ বলে ট্রাম্প যেভাবে অভিযোগ করছেন এবং ভোটের হিসাব পাল্টে দিতে জর্জিয়ার নির্বাচন কর্মকর্তাদের হুমকি দিচ্ছেন, তাতে এই অঙ্গরাজ্যের পুনর্নির্বাচনে রিপাবলিকান দুই প্রার্থী বেকায়দায় পড়েছেন। আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, ভোট বেআইনি ও দুর্নীতিপূর্ণ হবে—এমন ভেবে ট্রাম্পের অনেক কট্টর সমর্থক আজকের নির্বাচনে ভোট না–ও দিতে পারেন।

রক্ষণশীল পত্রিকা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট কোনো রাখঢাক ছাড়াই অভিযোগ করেছে, জর্জিয়ায় রিপাবলিকানদের ভরাডুবি হলে তার দায়ভার ট্রাম্পের। পত্রিকাটি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, কোনো প্রমাণ ছাড়াই কারচুপির যে অভিযোগ ট্রাম্প তুলেছেন, তা রিপাবলিকান ভোটারদের ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে রাখবে। ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট–এর মন্তব্য, মনে হয় জর্জিয়ার নির্বাচনে যাতে রিপাবলিকানরা পরাস্ত হন, তা নিশ্চিত করতে ট্রাম্প উঠেপড়ে লেগেছেন। পত্রিকাটি প্রশ্ন তুলেছে, ‘তিনি (ট্রাম্প) কি আসলে একজন ডেমোক্রেটিক চর?’