মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ফাটল সামনে আনল ইউক্রেন যুদ্ধ

সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও আবুধাবির যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান।
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর পশ্চিমাদের কাছে তুমুল সমালোচিত হয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এর জের ধরে পুতিন ও রাশিয়াবিরোধী বৈশ্বিক ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে মার্কিন প্রশাসনের এমন উদ্যোগের পরও মধ্যপ্রাচ্যে পুরোনো ও বিশ্বস্ত মিত্র বিশেষত সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ফাটল সামনে এসেছে। ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে মিত্রদের আস্থা ও বিশ্বাস ধরে রাখতে সংকটে পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

বাইডেন এখন উপসাগরীয় মিত্রদের সঙ্গে যেকোনো বৈরিতা এড়াতে চাইছেন। কেননা তিনি পুতিন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে মিত্রদেশগুলোকে এক কাতারে আনতে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। তিনি এ ক্ষেত্রে আরব দেশগুলোর বিশেষত সৌদি আরব ও ইউএইর মতো জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী দেশগুলোর সমর্থন চান।
জর্জিও কাফিয়োরো, ওয়াশিংটনভিত্তিক ভূরাজনৈতিক ঝুঁকিবিষয়ক বিশ্লেষক

আস্থার সংকট প্রকাশ্যে এসেছে গত সপ্তাহে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের ইউএই সফরের মধ্য দিয়ে। ২০১৩ সালে সিরিয়ায় আসাদবিরোধী লড়াইয়ে যোগ দেওয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাই বাশার আল-আসাদ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিত্র আবুধাবি সম্পর্ক স্বাভাবিক করুক, এটা চায়নি ওয়াশিংটন।

মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে সতর্ক করার পরও সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানিয়েছে ইউএই। ২০১১ সালে সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরুর পর এটাই ছিল বাশার আল-আসাদের প্রথম কোনো আরব দেশে রাষ্ট্রীয় সফর। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে বাশার আল-আসাদ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে সমর্থন দিয়েছেন।

ওয়াশিংটনভিত্তিক ভূরাজনৈতিক ঝুঁকিবিষয়ক বিশ্লেষক জিওরজিও কাফিয়োরো বলেন, বাশার আল-আসাদ এমন একটা সময়ে ইউএই সফর করেছেন, তার কিছুদিন আগেই ইউক্রেনে রুশ অভিযানের নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ইউএই ভোটদানে বিরত ছিল। এর মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশে গুরুত্ব দিচ্ছে ইউএই।

সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে গিয়ে দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাখতুমের সঙ্গে বৈঠক করেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ।

যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমের খবর, ভোটাভুটির আগে জো বাইডেন ইউএই ও সৌদি আরবের নেতাদের ফোন দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। এদিকে গত সপ্তাহে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়, চীনের সঙ্গে জ্বালানি তেলের বাণিজ্যে ডলারের বিপরীতে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে অর্থ লেনদেনে রাজি হয়েছে সৌদি আরব।

একের পর এক এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইউএই ও সৌদি আরব সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছে বলে মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাইস ইউনিভার্সিটির বেকার ইনস্টিটিউট ফর পাবলিক পলিসির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক ফেলো ক্রিস্টিয়ান কোটস আলরিচসেন। বার্তাটি হলো, ‘তোমাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) ঠিক করে দেওয়া নয়, বরং আমরা আমাদের স্বার্থরক্ষার বিষয়ে প্রাধান্য দিচ্ছি।’

দুশ্চিন্তা ক্রমেই বাড়ছে

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের খবরে বলা হয়, ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও আবুধাবির যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান বাইডেনের ফোন ধরেননি। তবে হোয়াইট হাউস বলেছে, এ খবর সঠিক নয়। তারা বারবার সৌদি আরব ও ইউএইর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরছে।

জিওরজিও কাফিয়োরো মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না সংযুক্ত আরব আমিরাত। কারণ, আবুধাবির নিরাপত্তার ‘গ্যারান্টার’ হিসেবে রয়েছে ওয়াশিংটন। তাঁর মতে, ওয়াশিংটনের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে আবুধাবির বিশেষত ‘আব্রাহাম চুক্তির’ মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে ইউএই। এরপরও ইউক্রেন ইস্যুতে দেশটিকে পুরোদমে পাশে পাচ্ছেন না বাইডেন।

ওয়াশিংটনের ইউএই দূতাবাস ৯ মার্চ জানায়, দেশটি জ্বালানি তেলের উত্তোলন বাড়াবে। যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা ছিল সেটাই। তবে এ ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইউএইর জ্বালানিমন্ত্রী টুইট করে জানান, তাঁর দেশ ওপেক প্লাসের সমঝোতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আপাতত তেল উত্তোলন বাড়ানো হচ্ছে না।

আল-জাজিরাকে জিওরজিও কাফিয়োরো বলেন, বাশার আল-আসাদকে দুবাই ও আবুধাবিতে স্বাগত জানানোয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বড় কোনো মূল্য চুকাতে হবে না, এই বিষয়ে ইউএইর নেতৃত্ব বেশ আত্মবিশ্বাসী।

বাশার আল-আসাদের ইউএই সফরের প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছে ওয়াশিংটন। সফর চলাকালে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস রয়টার্সকে বলেছিলেন, ‘এ সফর ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র বেশ হতাশ। এর মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আরব আমিরাতের কোনো কাজের এমন প্রকাশ্যে সমালোচনা বিরল।

ওয়াশিংটনের চাপের মুখেও আবুধাবি বাশার আল-আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রেখেছে। তবে আমিরাতের শাসকেরা ইয়েমেনের হুতিদের নিয়ে চিন্তিত। ইয়েমেন থেকে হুতিরা ইউএই ও সৌদি আরবে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নমনীয় প্রতিক্রিয়ায় খুশি নয় উপসাগরীয় দেশটি। হুতিদের হামলা প্রতিহত করতে ইউএইকে যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করার অস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্ক ট্যাংক কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্রাফটের গবেষক অ্যানেলি শিলাইন বলেন, মার্কিন প্রশাসন হুতিদের প্রতিরোধে রিয়াদ ও আবুধাবির পাশে রয়েছে। তবে এটা পর্যাপ্ত নয়। আমিরাত হুতিদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দেখতে চায়। আমিরাতের এ চাওয়ায় ওয়াশিংটন এখনো সাড়া দেয়নি।

বৈশ্বিক জ্বালানি তেল সরবরাহ

সাম্প্রতিক সময়ে নানা বিষয়ে মতের ভিন্নতা থাকার পরও বাইডেন প্রশাসন উপসাগরীয় মিত্রদের সঙ্গে বন্ধুত্ব জোরদার করতে আগ্রহী। ১০ মার্চ হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি জানান, প্রেসিডেন্ট বাইডেন গত ফেব্রুয়ারিতে টেলিফোনে সৌদি বাদশাহ সালমানের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ সময় দ্বিপক্ষীয় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।

এই মুহূর্তে বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেন সংকট সামাল দিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, দিচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে রাশিয়ার জ্বালানি খাত। ৮ মার্চ রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি বন্ধের ঘোষণা দেন বাইডেন। ইউরোপের অনেক দেশ রুশ তেল-গ্যাস আমদানি কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে।

জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী দেশগুলোর প্রতি গত বছর থেকেই উত্তোলন বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর জ্বালানি তেলের দাম অনেকটাই বেড়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের রপ্তানিকারকদের জোট ওপেক প্লাস (রাশিয়া, ইউএই, সৌদি আরব জোটের সদস্য) চলতি মার্চের শুরুতে জানিয়ে দেয়, তেল উত্তোলন বাড়ানোর পরিকল্পনা তাদের আপাতত নেই।

ওয়াশিংটনের ইউএই দূতাবাস ৯ মার্চ জানায়, দেশটি জ্বালানি তেলের উত্তোলন বাড়াবে। যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা ছিল সেটাই। তবে এ ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইউএইর জ্বালানিমন্ত্রী টুইট করে জানান, তাঁর দেশ ওপেক প্লাসের সমঝোতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আপাতত তেল উত্তোলন বাড়ানো হচ্ছে না।

জিওরজিও কাফিয়োরোর মতে, বাইডেন এখন উপসাগরীয় মিত্রদের সঙ্গে যেকোনো বৈরিতা এড়াতে চাইছেন। কেননা তিনি পুতিন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে মিত্রদেশগুলোকে এক কাতারে আনতে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। তিনি এ ক্ষেত্রে আরব দেশগুলোর বিশেষত সৌদি আরব ও ইউএইর মতো জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী দেশগুলোর সমর্থন চান। তাই এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র রিয়াদ ও আবুধাবির সঙ্গে মতবিরোধ এড়িয়ে চলবে।

প্রশ্ন যখন মানবাধিকার পরিস্থিতি

বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় একটি জায়গাজুড়ে রয়েছে মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর তাঁর সরকার সৌদি আরব ও ইউএইকে নিজ নিজ দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করার পাশাপাশি ইয়েমেন যুদ্ধে লাগাম টানার আহ্বান জানায়। সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ড নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় কৌশলগত সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ ছিল। গত বুধবার মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস সৌদি আরবে এক দিনে ৮১ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সমালোচনা করেছেন। তিনি সৌদি আরবে অভিযুক্তদের বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

ইউক্রেনে যুদ্ধ চলাকালে গত সপ্তাহে ইউএইর যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। এ বিষয়ে ক্রেমলিনের বরাতে রুশ সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অধিকার রয়েছে বলে আমিরাতের যুবরাজ পুতিনকে বলেছেন। পৃথক বিবৃতিতে ইউএই সরকার জানিয়েছে, ইউক্রেনে চলমান সংকট সমাধানে টেকসই রাজনৈতিক উপায় খুঁজতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে বলে পুতিনকে জানিয়েছেন যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান।

ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় মিত্ররা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন অ্যানেলি শিলাইন। এ বিষয়ে আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, এর ফলে অন্য দেশগুলোও বুঝতে পারবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বেশি নির্ভর করার যৌক্তিকতা নেই।

অন্যদিকে জিওজিও কাফিয়োরোর মতে, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চাইবে না তার উপসাগরীয় মিত্ররা রাশিয়া ও চীনের প্রভাববলয়ে যুক্ত হোক। বিশ্ব এখন বহু মেরুর পথে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। তাই আরব দেশগুলোর সামনে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ ত্যাগের সুযোগ রয়েছে।