যশোর রোডের গাছ কাটার ওপর ভারতের আদালত স্থগিতাদেশ আরও তিন সপ্তাহ বাড়িয়েছেন। গতকাল শুক্রবার এ-সংক্রান্ত মামলার শুনানি শেষে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য ও বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ান।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত যশোর রোডের গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের পরিবেশবাদীরা আন্দোলন শুরু করেন। প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ে চলে যাবে এই সড়ক ধরে। এশিয়ান হাইওয়ের দৈর্ঘ্য হবে ২০ হাজার ৫৫৭ কিলোমিটার। এ লক্ষ্যে সড়ক প্রশস্ত করার জন্য গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ও ভারত সরকার।
গাছ কাটার বিরুদ্ধে আবেদনকারীদের আইনজীবী রঘুনাথ চক্রবর্তী গতকাল জানান, সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিশীথা মাত্রের ডিভিশন বেঞ্চ এই গাছ কাটার ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে একটি কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
নির্দেশে বলা হয়, যেসব গাছ কাটার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেগুলো প্রাচীন কি না এবং সেসব গাছ কোন এলাকায় অবস্থিত, তা বিস্তারিত জানাতে হবে ওই কমিশনকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদনে কমিশন জানায়, সব গাছই প্রাচীন। যদিও এদিন ডিভিশন বেঞ্চ প্রথমে জানিয়েছিলেন, যেসব গাছ কাটা হবে, সেখানে প্রতিটি গাছের জন্য পাঁচটি করে গাছ লাগাতে হবে। এরপর মামলার আবেদনকারীরা ফের এক আবেদনে জানান, ওই ৩৫৬টি গাছ কাটার ওপর দেওয়া হোক স্থগিতাদেশ। কারণ, ওই সব গাছও প্রাচীন। আইনজীবী এ কথাও জানান, এই নিয়ে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে যেতে চান। এরপরই ডিভিশন বেঞ্চ আরও তিন সপ্তাহের জন্য স্থগিতাদেশ দেন।
বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের বুক চিরে চলে গেছে ঐতিহাসিক এই যশোর রোড। শুরু বাংলাদেশের যশোর জেলা থেকে। চলে এসেছে বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত বেনাপোল-পেট্রাপোল পেরিয়ে সোজা কলকাতায়। সেই যশোর রোড নিয়ে কত কথা, কত কাহিনি, কত ইতিহাস এখনো ঘুরে বেড়ায় এই উপমহাদেশে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই যশোর রোড হয়ে উঠেছিল এক জীবন্ত ইতিহাস। এই রোড দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাড়ি দিয়েছেন শত্রুর মোকাবিলায়। এই রোডের পাশে কত মুক্তিযোদ্ধা আর শরণার্থীর ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। এই রোড ঘুরেছেন সেদিন বিশ্বের তাবড় নেতা, কবি, সাহিত্যিকেরা। সেটার বিরাট ইতিহাস আজও জেগে রয়েছে।
এখন সেই যশোর রোড চওড়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক সড়কের মর্যাদা পেয়েছে। আজও যশোর রোডের দুপাশের শতবর্ষী বৃক্ষ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সেই বৃক্ষরাজিই আজ যশোর রোডের গর্ব। যশোর রোডের ইতিহাস।
গাছ কেটে যশোর রোড চার লেনে প্রশস্ত করার সিদ্ধান্তের পর তা নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন দুই দেশের পরিবেশবাদীরা। পেট্রাপোল (হরিদাসপুর) সীমান্ত থেকে কলকাতায় আসতে বারাসাত পর্যন্ত যশোর রোডের দীর্ঘ ৬১ কিলোমিটার পথে দাঁড়িয়ে থাকা এই শতবর্ষী বৃক্ষরাজিকে বাঁচাতে দুই দেশেই পৃথকভাবে আন্দোলন শুরু হয়।
ভারত সরকার যশোর রোডকে চার লেনের সড়কে রূপান্তর করার জন্য এই রোডের ৪ হাজার ৩৬টি গাছ কাটার জন্য প্রস্তাব দেয়। এর মধ্যে পেট্রাপোল থেকে বারাসাত পর্যন্ত এই ৬১ কিলোমিটার সড়কের মাঝে থাকা রেললাইনের ওপর ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য ৩৫৬টি শতবর্ষী গাছ কাটার প্রস্তাব দেয়। যাতে করে ওই ৩৫৬টি গাছ কাটা হলে রেললাইনের ওপর ফ্লাইওভার নির্মাণ করা সহজ হয়।
পরিবেশবাদীরা দাবি তোলেন, যশোর রোডের এক পাশের এই ঐতিহাসিক বৃক্ষকে সড়কের মাঝে রেখে দুদিকের রাস্তা চওড়া করতে হবে। যেমনটা হয়েছে পেট্রাপোল সীমান্ত থেকে কলকাতায় আসতে প্রথম দুই কিলোমিটার পথ। কলকাতা ও ঢাকার উচ্চ আদালতে গাছ কাটার বিরুদ্ধে মামলা করেছে মানবাধিকার সংস্থা ও পরিবেশবাদীরা। দুই দেশের মামলায় গাছ কাটার ওপর স্থগিতাদেশ জারি করেছেন আদালত।
গত ২৭ এপ্রিল কলকাতা হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিশীথা মাত্রে এবং বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ আবেদনকারীদের দাবি মেনে নিয়ে শতবর্ষী ৩৫৬টি গাছ কাটার ওপর সাময়িক স্থগিতাদেশ জারি করেছিলেন। এই মামলার পরবর্তী শুনানি হয় গতকাল। শুনানি শেষে আরও তিন সপ্তাহ স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হয়।
যশোর রোডের আরও ইতিহাস
ইতিহাস বলছে, মূলত যশোর থেকে বেনাপোল-পেট্রাপোল-বনগাঁ-হাওড়া-বারাসাত পার হয়ে কলকাতার শ্যামবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত ১২৫ কিলোমিটারের যশোর রোড। বাংলাদেশের অংশটুকু যশোর-বেনাপোল সড়ক নামে পরিচিত হলেও পেট্রাপোল সীমান্ত থেকে একেবারে কলকাতা এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে নাগের বাজার হয়ে শ্যামবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত এই সড়ককে যশোর রোড নামেই জানেন লোকজন। সাইনবোর্ডে কোথাও কোথাও লেখা চোখে পড়ে এই যশোর রোডের নাম। এই বিস্তৃত যশোর রোডের ৩৮ কিলোমিটার পড়েছে বাংলাদেশে। বাকিটা পশ্চিমবঙ্গে। যশোর রোডের আশপাশের চাঁদপাড়া, ঠাকুরনগর, গোবরডাঙ্গা, মছলন্দপুর, হাবড়া, বাণীপুর, গাইঘাটা আর অশোকনগরে একাত্তরে বাংলাদেশ থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা লোকজনের ঠাঁই হয়েছিল বিভিন্ন রোডের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা শরণার্থীশিবিরে। মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ এই যশোর রোড দেখে ১৯৭১ সালে লিখেছিলেন কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর যশোরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত করতে যশোর রোড হয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন অস্থায়ী বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ। তাই সেই যশোর রোড আজও ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বমহিমায়।
যশোর রোডের আরও ইতিহাস জানতে একটু পেছনের দিনে ফেরা যাক। সম্রাট শের শাহ ১৫৪০ থেকে ১৫৪৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সোনারগাঁও থেকে আজকের পাকিস্তান পর্যন্ত তৈরি করেন গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড। যশোর-বেনাপোল-বনগাঁ-কলকাতা ছুঁয়ে লাহোর-পেশোয়ার অবধি চলে গেছে এই রোড। আবার ইংরেজদের বাংলা দখলের আগে সংস্কারের অভাবে এই রোড মেঠো পথে পরিণত হয়। তখন দস্যু-তস্করের হামলার ভয়ে ঝুঁকি নিয়ে এই পথ দিয়েই চলাচল করতেন রাজকর্মচারী ও ব্যবসায়ীরা। তখন যশোর থেকে কলকাতায় যাওয়ার বিকল্প মাধ্যম ছিল নৌপথ। এরপর যশোর জেলা হওয়ার সুবাদে বেড়ে যায় যশোরের গুরুত্ব। প্রসার ঘটে ব্যবসা-বাণিজ্যের। তখন যশোরে গড়ে ওঠা উচ্চ ও মধ্য শ্রেণির প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু। হিন্দুদের কাছে তখনো গঙ্গাস্নান একটি পুণ্যের কাজ ছিল। সেই সময় যশোর থেকে বহু হিন্দু নারী গঙ্গাস্নানের জন্য নদীপথে কলকাতা যেতেন। আবার কেউ কেউ পালকিযোগেও যেতেন। তাঁরা যেতেন বনগাঁ হয়ে চাকদহের গঙ্গার ঘাটে। যশোর থেকে চাকদহের দূরত্ব ছিল ৮০ কিলোমিটার।
সে সময় যশোর শহরের বকচরের জমিদার ছিলেন কালী প্রসাদ পোদ্দার। কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। নৌকার মাঝিদের অসহযোগিতার কারণে একবার জমিদারের মা গঙ্গাস্নানে যেতে না পারায় নিজেকে অপমানিত বোধ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে অনশনে বসেন। উদ্বিগ্ন পুত্র দরজা খোলার অনুরোধ জানালে মা শর্ত দেন, গঙ্গাস্নানের জন্য যশোর থেকে চাকদা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করে দিলেই তিনি অনশন প্রত্যাহার করবেন। পুত্র কালী প্রসাদ মায়ের দাবি মেনে রাস্তা নির্মাণ করেন। ফলে এই রাস্তাকে অনেকে কালীবাবুর সড়ক বলেও অভিহিত করেন। ১৮৪৫ সালের দিকে ভারতের তৎকালীন গভর্নর অকল্যান্ডের সহযোগিতায় এই সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হয়। আর সেদিন এই সড়কের পাশে বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে লাগানো হয় প্রচুর শিশুগাছ। সেই গাছই আজ শতবর্ষী গাছের তকমা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যশোর রোডজুড়ে।