ব্যক্তি থেকে বিশ্ব সবই বদলে দেবে করোনাভাইরাস

ভালো বা মন্দ-যেমনই হোক, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকট অভাবনীয়ভাবে বদলে দেবে বিশ্বকে। ছবি: রয়টার্স
ভালো বা মন্দ-যেমনই হোক, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকট অভাবনীয়ভাবে বদলে দেবে বিশ্বকে। ছবি: রয়টার্স

সারা বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সঙ্গে বদল নিয়ে এসেছে চিন্তায়ও। উন্মোচন করে দিয়েছে এত দিনকার রাষ্ট্রব্যবস্থা ও কাঠামোয় বিদ্যমান গলদগুলো। বিশ্বজুড়েই মানুষ এক নতুন উপলব্ধির সামনে দাঁড়িয়ে। এ কারণে মহামারি–পরবর্তী বিশ্ব যে অনেক দিক থেকেই এখনকার চেয়ে আলাদা হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ভালো বা মন্দ—যেমনই হোক, এই সংকট অভাবনীয়ভাবে বদলে দেবে সামাজিক বিন্যাস। মার্কিন পত্রিকা পলিটিকো সম্প্রতি বৈশ্বিকভাবে করোনাভাইরাস মহামারির প্রেক্ষাপটে ৩০ জনের বেশি বুদ্ধিজীবীর মত নিয়েছে। তাঁদের দেওয়া মতের সারসংক্ষেপ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—

১. স্পর্শ না করাটা রেওয়াজে পরিণত হতে পারে, যা সমাজ ও সংস্কৃতিতে বড় প্রভাব ফেলবে। অনলাইন যোগাযোগের সঙ্গে বাড়বে মানুষে মানুষে দূরত্বও।

২. বর্তমানে চিকিৎসক, নার্স থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা কোনো আগ্নেয়াস্ত্র না উঁচিয়েই মানুষের জীবন রক্ষায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করছেন, যার মধ্য দিয়ে দেশপ্রেম ধারণার বেসামরিকীকরণ ঘটতে পারে।

৩. রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মেরুকরণ কমে আসবে।

৪. নতুন করোনাভাইরাসের মতো ‘অভিন্ন শত্রুর’ বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে দলীয় ও মতাদর্শিক বিভাজনের বদলে মানুষ ঐক্য ও সংহতির গুরুত্ব অনুধাবন করবে।

৫. বিশেষায়িত জ্ঞানের প্রতি মানুষকে উদাসীন করে তোলা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা বদলে এমন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে যেখানে বিশেষায়িত জ্ঞানের প্রতি জন-আস্থা বাড়বে।

৬. করোনাভাইরাস মহামারি বাজার-সংস্কৃতি ও অতিমাত্রায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের সঙ্গে আমাদের প্রণয়ের অবসান ঘটাতে পারে।

৭. কর্তৃত্ববাদী ও চরম নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রের বিষয়টি এখন বাস্তব; নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবনে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বাড়বে।

৮. ধনী-গরিবনির্বিশেষে সারা বিশ্বের মানুষের অস্তিত্ব একসূত্রে গাঁথা—এমন উপলব্ধি মানুষকে যূথবদ্ধতার শক্তি অনুধাবনে সহায়তা করবে।

৯. কোয়ারিন্টিনের এই সময় ধর্মের উপাসনার রীতি ও উপাস্য দুই ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ করবে।

১০. ধ্যানচর্চা বা মেডিটেশনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার মঙ্গল চান—এমন ব্যক্তিদের সামাজিক মর্যাদা বাড়বে।

১১. বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় থাকা ত্রুটিগুলো প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী এক নতুন সংস্কার আন্দোলনের জন্ম হতে পারে, যা এমনকি বিভিন্ন দেশে সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনেও রূপ নিতে পারে।

১২. শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন জরুরি বিষয়কে অনলাইনভিত্তিক করার চাপ বাড়বে প্রশাসনগুলোর ওপর।

১৩. ঘরে বসে কাজ করার যে রেওয়াজ এই সময়ে তৈরি হচ্ছে, তা অক্ষুণ্ন রাখার চাপ তৈরি হবে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর।

১৪. স্বাস্থ্যকর ডিজিটাল জীবনযাপনের বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়বে।

১৫. বেশ কয়েক বছর ধরে ব্যয় সংকোচন এবং তাৎক্ষণিক ও উচ্চ মাত্রার সেবার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিবেচিত হওয়া টেলিমেডিসিনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।

১৬. শ্রেণি-পেশানির্বিশেষে নাগরিকদের জন্য কার্যকর সুরক্ষা বলয় তৈরির চাপ বাড়বে রাষ্ট্রের ওপর।

১৭. মুনাফাকেন্দ্রিক ওষুধনীতির বদলে স্বাস্থ্যসেবা এবং ওষুধের উন্নয়ন ও উৎপাদনে আরও সরাসরি ও কার্যকর ভূমিকা রাখার জন্য সরকারগুলোর ওপর চাপ বাড়বে।

১৮. জনস্বাস্থ্য ও মহামারির মতো বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দক্ষতা ও বিজ্ঞানের প্রতি জন-আস্থা বাড়বে।

১৯. ভার্চ্যুয়াল আইন প্রণয়নের কাজ শুরু হতে পারে, যা তদবিরের সংস্কৃতি রোধে কার্যকর হয়ে উঠবে।

২০. বর্তমান পরিস্থিতি কেটে যাওয়ার পর দরকার হবে আরও বৃহৎ ও বিজ্ঞ সরকার ব্যবস্থা।

২১. জলবায়ু পরিবর্তন ও ঐতিহাসিক বৈষম্যের এ যুগকে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির যুগে রূপান্তরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো অলিম্পিক গেমস পেছাল। রয়টার্স

২২. বিদ্যমান বহু আইন ও নীতি অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় নতুন সামাজিক চুক্তির আলোকে সার্বিক পরিবর্তনের দাবি জোরদার হবে।

২৩. বহুপক্ষীয় কূটনীতি শুধু নয়, বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলায় শত্রু-মিত্র সবার সঙ্গে সহযোগিতার গুরুত্ব নতুন করে উপলব্ধি করবেন বিশ্বনেতারা।

২৪. তথ্য গোপন বা বিকৃত না করে জনগণকে আস্থায় নেওয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করবে রাষ্ট্র।

২৫. মূলধারায় আসবে ইলেকট্রনিক ভোটিং ব্যবস্থা।

২৬. ঝুঁকি কমাতে চিঠির মাধ্যমে ভোট দেওয়া বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।

২৭. বৈশ্বিক মহামারির আতঙ্ক সমাজকে বাধ্য করবে ভোগের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়টিকে মেনে নিতে।

২৮. গণহারে বিচ্ছিন্ন থাকার অবধারিত ফল হিসেবে সামনে চলে আসবে মানুষে মানুষে সংসর্গের উচ্চ চাহিদা এবং ছোট পরিসরে হলেও উচ্চ জন্মহারের মতো বিষয়।

২৯. অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থা শক্তিশালী হবে।

৩০. ভোক্তা ও করপোরেশন উভয়েরই ব্যয় বাড়বে।

৩১. সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন শ্রেণির মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধিই শুধু নয়, মধ্যবর্তী শ্রেণিগুলোর মধ্যেও বৈষম্য বাড়বে।

৩২. এই মহামারি শেষে মানুষ নানা দিক থেকে মুক্তি চাইবে; বাড়িয়ে দেবে পারস্পরিক যোগাযোগ।

৩৩. বাইরে খাওয়া ও পার্টি করার প্রবণতা কমে ঘরে রান্নার ঝোঁক বাড়বে।

৩৪. মহামারি শেষে শপিংমলকেন্দ্রিক সংস্কৃতির বদলে উদ্যানসহ বিভিন্ন উন্মুক্ত জনপরিসরের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়বে।

৩৫. রক্ষণশীল ও উদারনৈতিক ধারণার পাল্টাপাল্টি বিন্যাসে আটকে থাকা ‘পরিবর্তন’ ধারণায় বদল আসবে মূলগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।

৩৬. দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে সু-অভ্যাস শেখানো প্ল্যাটফর্মগুলো অকেজো প্রমাণিত হওয়ায় মানুষ আবার তার সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তির ওপর আস্থা রাখতে শিখবে।

৩৭. কাজ, কাজ এবং কাজ—সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে স্বীকৃত এই প্রচার থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষ নিজের ও নিজ পরিবারের দিকে আরও বেশি মনোযোগী হবে।

আরও পড়ুন:

করোনাভাইরাস: বিশ্ব যেভাবে বদলে যাবে (পর্ব-১)
করোনাভাইরাস: বিশ্ব যেভাবে বদলে যাবে (পর্ব-২)
করোনাভাইরাস: বিশ্ব যেভাবে বদলে যাবে (পর্ব-৩)
করোনাভাইরাস: বিশ্ব যেভাবে বদলে যাবে (শেষ পর্ব)
‘খিলগাঁও সিনড্রোম’ কীভাবে রুখব?
বিশ্বটা যেভাবে পাল্টে যাবে
হায়, গুলিতে তো করোনা মরে না