>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সবার জীবনের বাস্তবতা। আমরা এখানে শুনছি পাঠকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরা লিখছেন পরিবারের আনন্দ-বেদনাভরা গল্প। শোনাচ্ছেন এ সময়ের কোনো মানবিক সাফল্যের কাহিনি। প্রথম আলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে পাঠকের গল্প। দেশ বা প্রবাসে থেকে আপনিও লিখুন আপনার অভিজ্ঞতার কথা। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সের ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোবায়োলজিতে পিএইচডি গবেষক হিসেবে যোগ দিই। আমার স্বামীও এখান থেকে পিএইচডি করেছেন। প্রতিষ্ঠানটি বেইজিংয়ের ডাউনটাউনে। পিএইচডির কোর্স ওয়ার্কের কাজে আমরা গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইউনিভার্সিটির মেইন ক্যাম্পাসে চলে আসি। তখন আমি গর্ভবতী। ১০ নভেম্বর আমাদের সন্তান হয়। ঠিক করেছিলাম, এই সেমিস্টার শেষে চায়নিজ নববর্ষের ছুটির পর বেইজিং ডাউনটাউনে ফিরে যাব।
১০ জানুয়ারি থেকে চায়নিজ নববর্ষের ছুটি শুরু। সবাই বিভিন্ন প্রদেশে যার যার প্রতিষ্ঠানে যেতে শুরু করল। আমার সাতজন বন্ধুর গবেষণা প্রতিষ্ঠান উহানে। ৯ জানুয়ারি সবশেষে বিদায় দিলাম আমাদের নাইজেরিয়ার বন্ধুকে। নবপরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে আমার বাসায় রাতে খেয়েই ওরা ট্রেনে করে উহানে রওনা দিল। তখনো কি জানি, সামনে কী হতে চলেছে?
২৪ জানুয়ারি চায়নিজ নববর্ষের মূল অনুষ্ঠান। ২০ জানুয়ারির পর বেইজিং ঈদের ঢাকার মতো ফাঁকা। এর মধ্যে ভাইরাসের দু-একটা খবর আমাদের চোখে পড়েছে। গুরুত্ব দিইনি। ছুটিতে সপ্তাহখানেক দোকানপাট বন্ধ। তাই কিছু খাবারদাবার কিনে রাখলাম। ভাইরাসটির ভয়াবহতা আমাদের বোধগম্য হলো আস্তে আস্তে, ২০ জানুয়ারির পরে। ২৩ জানুয়ারি উহান লকডাউন হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল বেইজিং থেকে অন্যান্য প্রদেশের সঙ্গে যোগাযোগ। কেউ ডরমিটরি ক্যাম্পাসের বাইরে যেতে পারবে না, এমন নির্দেশ দিয়ে নিরাপত্তাকর্মী বসিয়ে দেওয়া হলো ফটকে।
শুরু হলো ডরমিটরিতে ঘরে ঘরে গিয়ে ছাত্রদের তাপমাত্রা মাপা। আমরা যারা বাইরে বাসা নিয়ে থাকি, অনলাইন ফরম পূরণ করে শরীরের অবস্থা জানিয়ে ইউনিভার্সিটিতে পাঠাতে হয়। কমিউনিটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা এসে সবার তাপমাত্রা মেপে বিস্তারিত তথ্য নেয়। স্থানীয় থানা ফোন করে খবর নেয়, আমরা সুস্থ আছি কি না। তিনবার ক্রসচেক করে তথ্যের যথার্থতা যাচাই করা হয়। শুধু আমাদের নয়, সব নাগরিকের। কমিউনিটি থেকে আমাদের কার্ড দেওয়া হলো। বাইরে যেতে পারত পরিবারপ্রতি মাত্র একজন।
আমাদের আর ইনস্টিটিউটে যাওয়া হলো না। দিন দিন অবস্থার অবনতি হতে লাগল। অনেক বাংলাদেশি আতঙ্কে দেশে ফিরতে শুরু করলেন। আমাদের সে উপায় নেই। আমাদের আড়াই মাসের ছেলের পাসপোর্ট হয়নি। ধীরে ধীরে আমরা একা হয়ে গেলাম। বাংলাদেশ থেকে মা-বাবা প্রতিদিন ফোন করে কান্নাকাটি করেন। আমরা মাইক্রোবায়োলজির ছাত্র। এই ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি জানি। ভয় দিন দিন আমাদের মনোবল ভেঙে দিচ্ছিল। সকাল-বিকেল দূতাবাসে ফোন দিতাম। দেশ থেকে পাসপোর্ট এলেও চীনের সব অফিস বন্ধ। দূতাবাসে সেটি পৌঁছাতে পারছিল না। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু ভাবতাম, সব কি ঠিক হবে? আমার সন্তান এই সুন্দর পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করতে পারবে তো?
সবকিছুই আমরা অনলাইনে কিনতাম। টাকা তোলার জন্যও বুথে যাওয়ার দরকার নেই। এখানে বেশির ভাগ মানুষ কাগজবিহীন টাকার লেনদেন করে। সবার একটা উইচ্যাট অ্যাকাউন্ট আছে। তাতে আছে নিজস্ব কিউআর কোড। ঘরে বসেই অ্যাকাউন্টের টাকা উইচ্যাটে ট্রান্সফার করা যায়।
বাসায় বসে গবেষণার সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত নিয়মিত তত্ত্বাবধায়ককে পাঠাই। ফাঁকে ছবি দেখি আর আপনজনদের সঙ্গে মোবাইলে বেশি বেশি কথা বলি। ইতিবাচক ভাবনা ভাবি।
ধীরে ধীরে চীনে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমে এল। উহানে আমার বন্ধুরাও সুস্থ। মানুষ কর্মজীবনে ফিরতে শুরু করেছে। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানতে হচ্ছে সর্বোচ্চ সতর্কতা। প্রথমবারের মতো আমি আমার সন্তানকে বাসার নিচে চেরিফুল দেখিয়ে আনলাম।