সংঘাত এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গত বছর রেকর্ডসংখ্যক মানুষ নিজ দেশে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ফলে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে হয়েছে তাঁদের। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যবেক্ষণকারী দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। খবর এএফপির।
ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার (আইডিএমসি) ও নরওয়েজিয়ান রিফিউজি সেন্টারের (এনআরসি) যৌথ ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে ২০২১ সালে নিজ দেশের ভেতরে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৯১ লাখ। তবে চলতি বছর অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধ। দেশটি থেকে অভ্যন্তরীণভাবে ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ২০২১ সালেই নিজ দেশের ভেতর নতুন বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৮০ লাখ। এ সময় কিছু মানুষ একাধিকবার তাদের বাসস্থান ছাড়তে বাধ্য হন। ২০২০ সালেও ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির ঘটনা দেখেছিল বিশ্ব। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ওই সময় অনেক মানুষকে নিজেদের বাসস্থান ছাড়তে হয়।
গত বছর শুধু সংঘর্ষের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৪৪ লাখে; যা আগের বছরের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের ভেতর ৮০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
আইডিএমসির পরিচালক আলেকজান্দ্রা বিলাক বলেন, ‘২০২২ সালে আরও খারাপ চিত্র দেখতে হবে। ২০২১ সালে রেকর্ডসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। শান্তি-প্রচেষ্টার জন্য এই চিত্র সত্যিই একটি দুঃখজনক অভিযোগ।’
এনআরসির প্রধান জ্যান ইগল্যান্ড সতর্ক করে বলেন, ‘পরিস্থিতি এতটা বাজে কখনো ছিল না। বিশ্ব বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। আমাদের রেকর্ড বলছে, বর্তমান পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই অনেক খারাপ।’
গত বছর আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোয় অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। শুধু ইথিওপিয়াতেই ৫০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে। দেশটির টাইগ্রে অঞ্চলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও তীব্র খরার কারণে এই বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটে। কোনো একক দেশ হিসেবে সর্বোচ্চ বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ছিল এটাই।
গত বছর ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো (ডিআরসি) ও আফগানিস্তানেও ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির ঘটনা দেখা যায়। আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতায় ফেরার পাশাপাশি ব্যাপক খরার কারণে অনেকেই তাঁদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার পর সেখানেও বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। তবে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে কিছুটা ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। সেখানে নতুন করে বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা সর্বনিম্ন স্তরে নেমেছে। কারণ, সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাকে উত্তেজনা কমতে শুরু করেছে। তবে ওই অঞ্চলের সর্বমোট বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা এখনো অনেক বেশি।
সিরিয়ায় ১১ বছরের বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। এখনো সেখানে সর্বোচ্চসংখ্যক অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির ঘটনা রেকর্ড করা হয়। ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশটিতে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৬৭ লাখ ছাড়িয়েছে। এরপর রয়েছে ডিআর কঙ্গো (৫৩ লাখ), কলাম্বিয়া (৫২ লাখ), আফগানিস্তান ও ইয়েমেন (৪৩ লাখ)।
সংঘর্ষের কারণে বাস্তুচ্যুতি সত্ত্বেও এখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের কারণে অভ্যন্তরীণ নতুন বাস্তুচ্যুতির ঘটনা বেশি। গত বছর ২ কোটি ৩৭ লাখ মানুষ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৯৪ শতাংশ মানুষ ঘূর্ণিঝড়, মৌসুমি বৃষ্টিপাত, বন্যা এবং খরার মতো আবহাওয়া এবং জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপর্যয়ের মুখে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের চরম আবহাওয়ার ঘটনার তীব্রতা বাড়ছে। এ ধরনের ঘটনা ঘন ঘন ঘটছে একই কারণে। এতে চীন, ফিলিপাইন ও ভারত সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। দুর্যোগের কারণে গত বছর এই তিন দেশে সবচেয়ে বেশি অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষ বেড়েছে। এনআরসির প্রধান এগল্যান্ড বলেন, ক্রমবর্ধমান সংঘাত এবং বিপর্যয়ে সমস্যাগুলো জটিল হচ্ছে এবং ঝুঁকিও প্রবল হচ্ছে। এতে মানুষ বারবার বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হচ্ছে। মোজাম্বিক, মিয়ানমার, সোমালিয়া এবং দক্ষিণ সুদানের মতো জায়গায় সংকটে খাদ্যনিরাপত্তাকে প্রভাবিত করে এবং লাখ লাখ মানুষের জন্য ঝুঁকি তৈরি হয়।
এগল্যান্ড বলেন, ‘এই ক্রমবর্ধমান মানবিক যন্ত্রণার অবসান ঘটানোর জন্য কীভাবে সংঘাত প্রতিরোধ ও সমাধান করা যায় সে সম্পর্কে বিশ্বনেতাদের চিন্তাভাবনায় বিশাল পরিবর্তন দরকার।’