থাকি প্রবাসে আর করি দেশ দেশ। দেয়ালে বাংলার ছবি, বাংলার ম্যাপ। শেলফ ভর্তি বাংলা বই, টেলিভিশনে বাংলা গান, হাতে বাংলা পত্রিকা। চরিত্রে রবীন্দ্র উপমা ‘মিলাবে আর মিলিবে, দেবে আর নেবে’, স্বপনে স্বপ্নাতুর চির বিরহী অতৃপ্ত নজরুল ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’। দেশে গেলে এনআরবি আর প্রবাসে অভিবাসী। এঁদেরই নাম প্রবাসী। আমরা প্রবাসী। এই আমাদের জীবন, এই আমাদের সাহিত্য। ফিকশন-নন ফিকশন, বাস্তব আর কল্পনার সমন্বয়ে যদি রূপায়িত হয় সাহিত্য তাহলে তার প্রথম উপকরণ আর উদাহরণ হচ্ছি আমরা। আমাদের পুরো জীবনটাই একটা উপন্যাস, একটি গ্রন্থ, একটি ইতিহাস—আর তার নায়ক-নায়িকা, পার্শ্বচরিত্রে আনমনে অভিনয় করে চলেছি আমরা। মাঝে মাঝে যখন নাড়ি ধরে টান দেয় আজন্মলালিত সংস্কার-সংস্কৃতি, অন্তরে লালিত কাব্যিক ছন্দ, তখন মনে হয় কোথাও যেন গিয়ে একটু ভাগাভাগি করি পুঞ্জিত ব্যথা। একটু আস্বাদন করি বাংলা সাহিত্যের রস, প্রাণ শীতল করি বাংলার কবি-সাহিত্যিক আর গুণীজনদের কণ্ঠে আবৃত্তি, আলোচনা আর হাস্যরসে ভরপুর কত শত প্রাণখোলা কথামালায়। এখন আর আগেকার মতো নাই নাই ভাব যেন নাই। এখন চারদিকে তাকালে মনে হয় আছে আছে। সভা-সমিতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, পথ মেলা, বাংলা মেলা, নাটক, গান-বাজনা, সাহিত্য আলোচনা সব মিলিয়ে চারদিকে বাঙালিয়ানার অভাববোধ হয় না।
গত ১৪ অক্টোবর টরন্টোর ৯ ডজ রোডের লিজিয়ন হলে তেমনি এক বাঙালিয়ানার আড্ডায় জড়ো হয়েছিলেন কানাডার বিভিন্ন প্রান্ত ও মূলধারার লেখক, কবি, ঔপন্যাসিক ও সাহিত্যানুরাগী কয়েক শ জন। বেঙ্গলি লিটারারি রিসোর্স সেন্টার (বিএলআরসি) আয়োজন করেছিল বাঙালি লেখক সম্মেলন ২০১৭। এটা ছিল দ্বিতীয় সম্মেলন। দীর্ঘদিন যাবৎ লেখালেখি করি না। তাই না-লেখাটাও যেন একটি অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিএলআরসির অনুষ্ঠানের পর থেকেই কিছু বলার যেন এক তাগাদা অনুভব করছিলাম।
টরন্টোতে সময়ে সময়ে আরও অনেক সাহিত্য সংগঠন হয়েছে। লক্ষ্যহীন যাত্রা যেমন পথ হারিয়ে ফেলে তেমনি ওই প্রচেষ্টাগুলোও একসময় ইতিহাস হয়ে গেছে। তারপরও ওগুলোকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সময়ের দাবি সময়েই মেটাতে হয়। এখন কানাডায় আমাদের কমিউনিটি অনেক বড় হয়েছে, সাহিত্যচর্চার পরিসর বড় হয়েছে; এর সঙ্গে আমাদের বাড়তি পাওনা হয়েছে দেশবরেণ্য অনেক কবি-সাহিত্যিক এখন কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। এ দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসরত প্রবাসী লেখক ও সাহিত্যিকদের নিয়ে বিএলআরসি যে যাত্রা শুরু করল তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং লক্ষ্যে অনেক ভিন্নতা রয়েছে।
বিএলআরসিতে আমি যা লক্ষ করেছি তা হচ্ছে, কানাডায় বসবাসরত সব লেখকের একটি প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা; বাংলা সাহিত্যকে কানাডার মূলধারার সাহিত্য ও সাহিত্যিকের সঙ্গে একটি যোগসূত্র করানো; এখানে জন্ম নেওয়া বা বেড়ে ওঠা প্রজন্মের হাতে ইংরেজিতে লেখা বাংলা সাহিত্য বা ইতিহাস গ্রন্থ তুলে দেওয়া। বিএলআরসিতে প্রথম থেকে যাঁরা জড়িত তাঁদের চিন্তা-চেতনা এবং দূরদর্শী ও কৌশলগত পরিকল্পনা মূলত কমিউনিটির জন্য একটি আগাম বার্তা নিয়ে এসেছে। আমরা একটি সঠিক সম্ভাবনার উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা লক্ষ করছি। বাংলা, বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য চর্চা এবং কর্মতৎপরতার সীমানা পেরিয়ে কানাডীয় মূল স্রোতের সঙ্গে সেতুবন্ধন, সংযুক্তিকরণ, আমাদের সাহিত্য ও ইতিহাসকে কানাডীয় সাহিত্যিক ও পাঠকদের কাছে পাঠোপযোগী করে উপস্থাপন এবং আমাদের লেখক ও কানাডীয় সাহিত্যিকদের মধ্যে যোগসূত্র ইত্যাদি পরিকল্পনার প্রাথমিক বাস্তবায়ন আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি।
১৪ অক্টোবরের সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন টরন্টো পয়েট লরিয়েট এন মাইকেলস, রাইটারস ইউনিয়ন অব কানাডার নির্বাহী পরিচালক কবি, কলামিস্ট ডন ডেগেন, রাইটার্স ট্রাস্ট অব কানাডার নির্বাহী পরিচালক মেরি অসবর্ন প্রমুখ। অন্যদিকে আমাদের কমিউনিটির বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক আসাদ চৌধুরী, লেখক ড. দিলীপ চক্রবর্তী, কবি ইকবাল হাসান প্রমুখ। এই যে দুই ভিন্ন সংস্কৃতি ও সাহিত্যমোদীর এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যকে জানার প্রয়াস, এই প্রয়াসের মধ্যেই নিহিত রয়েছে আমাদের সাহিত্য, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের বীরত্বের গাঁথাকে কানাডীয় কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে উপস্থাপন করে একটি জাতি হিসেবে যে আমাদের অনেক গর্ব আছে তা তুলে ধরা।
গূঢ় সত্য কথা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ যদি স্বচেষ্টায় গীতাঞ্জলিকে ইংরেজিতে অনুবাদ না করতেন তাহলে হয়তো বাঙালির কপালে বাংলায় সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জুটত না। বাংলা ভাষায় আরও অনেক ক্ষণজন্মা কবি-সাহিত্যিক যেমন নজরুল, শরৎ চন্দ্র, জীবনানন্দ দাস প্রমুখ রেখে গেছেন অমর সৃষ্টি। কে জানে শুধু প্রচেষ্টার অভাবে বাংলা সাহিত্য হয়তো আরও নোবেল বিজয়ের সম্ভাবনা হারিয়েছে অজান্তে। সুতরাং বিশ্ব সাহিত্যে কানাডার সাহিত্য অঙ্গনে আমাদের বাংলা সাহিত্যকে উপস্থাপন মতো যে সুন্দর একটি পদক্ষেপ বিএলআরসি নিয়েছে তাকে শুধুই সাধুবাদ না জানিয়ে তাকে সঠিকভাবে সহযোগিতার দায়িত্ব পুরো কমিউনিটির ওপর। এই দায়িত্ব যদি সঠিকভাবে পালন করা হয় এবং বিএলআরসি যদি তার কক্ষপথ থেকে ছিটকে না পড়ে, তাহলে অবশ্যই এর সুফল পাবে কমিউনিটি এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
আমরা যে মোজাইক সোসাইটিতে বসবাস করছি সেখানে পৃথিবীর সব দেশের মানুষ বাস করছে। এখানে সুযোগ যেমন প্রচুর তেমনি প্রতিযোগিতাও অনেক। প্রসঙ্গক্রমে আমি পাঞ্জাবিদের কথাই বলি। ওরা ওদের জাতীয় (ভারতীয়) পরিচয়ের পাশাপাশি একটি গোষ্ঠী (পাঞ্জাবি) হিসেবে কানাডীয় সমাজে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করে নিয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা হওয়া থেকে শুরু করে ওদের দাপট এখন সর্বত্র। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে ওদের পাঞ্জাবি ভাষার ব্যবহারও লক্ষণীয়। আমি মানছি, আমাদের কমিউনিটি এখানে নতুন। নতুন বলে তো বসে থাকার ফুরসত নেই। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাহিত্যে প্রতিটি ক্ষেত্রে যার যার অবস্থান থেকে সঠিক সাংগঠনিক তৎপরতার বিকল্প আছে কি? দুই যুগ ধরে তো শত শত সংগঠনের জন্ম দিয়েছি এবং বিভাজন অব্যাহত রেখেছি কিন্তু অদ্যাবধি কমিউনিটি থেকে প্রতিনিধিত্বশীল একজন কাউন্সিল জন্ম দিতে পারিনি।
আজ আমার মনে পড়ছে, বিপেক নামে আমাদের একটি সংগঠনের সম্মেলনে প্রথমবারের মতো টরন্টোর একজন মেয়র ডেভিড মিলার উপস্থিত হয়ে ‘অ্যাকশন ইজ লাউডার দ্যান ওয়ার্ড’ স্লোগান দেখে কমিউনিটির ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু এরপর অনেকবারই আমরা মেয়র, এমপিদের উপস্থিত হতে দেখেছি কিন্তু সেগুলো শুধুই সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে। বিএলআরসির দুটি সম্মেলনেই একজন দর্শক-শ্রোতা এবং লেখক হিসেবে উপস্থিত থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। ধন্য মনে করছি এই জন্য যে, কানাডীয় সাহিত্যিকেরা এই প্রথম আমাদের সাহিত্য আসরে এসে বাঙালি ও বাংলার সাহিত্যরস আস্বাদন করলেন এবং সাহিত্য নিয়ে আমাদের কবি-সাহিত্যিক আর কমিউনিটির স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজন দেখে কিছুটা বিস্মিত হলেন। এই যে কানাডীয় সাহিত্যিকদের বিস্মিত হওয়া বা আসা—এর মধ্য দিয়েই আমাদের সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন সুদৃঢ় হবে। আর এই বন্ধন যখন পোক্ত হবে তখনই আসবে সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক আর অর্থনৈতিক সুফল।
বিএলআরসি ইতিমধ্যেই তাদের ওয়েবসাইটে কানাডায় বসবাসরত প্রায় ১০০ বাঙালি লেখকের সংক্ষিপ্ত জীবনী দিয়েছে। ওই লেখকদের অনেকেই আবার ইংরেজিকে তাঁদের সাহিত্য মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আমার ধারণা ওই লেখকেরাই মূলত হয়ে উঠতে পারেন আমাদের গেম চেঞ্জার বা বন্ধনের ‘সেতু’। সম্মেলনে তাঁদের উপস্থিতি আমাদের আশান্বিত করেছে। তৃতীয় যে কাজটি বিএলআরসি হাতে নিয়েছে ‘আমাদের প্রজন্মকে ইংরেজিতে বাংলা সাহিত্য বা ইতিহাস শেখানো।’ এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর কোনো বিকল্প যে নেই তা ভেবেই হয়তো বিএলআরসিকে এই ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প হাতে নিতে হয়েছে।
ঝুঁকি বলছি এ জন্য যে, এ ধরনের পদক্ষেপের জন্য বিএলআরসিকে হয়তো বা অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। আজ থেকে এক যুগ আগে এই ধারণাটি আমার একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম তার জন্য আমাকে অনেক শুনতে হয়েছে। তবে সময় তো পাল্টেছে, আমাদের চিন্তা-চেতনার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বিএলআরসির এই প্রজেক্ট সময়ের সঠিক পদক্ষেপ বলেই সবাই মনে করছেন। আমাদের এখানে জন্ম নেওয়া বা বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের হাতে ইংরেজিতে অনূদিত বাংলা সাহিত্য বা ইতিহাস গ্রন্থ তুলে দিতে পারলেই আপনা-আপনি ওরা আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে বেড়াবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আমাদের নতুন প্রজন্ম যে ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছে সেটাই তাদের দেশ, ভাষা ও তাদের সংস্কৃতি। তাদের কোনোভাবেই জোর করে বাংলায় বাংলা সাহিত্যে গলাধঃকরণ করানো সম্ভব নয়। সুতরাং বাবা-মায়ের বা পূর্বপুরুষের সাহিত্য-সংস্কৃতি ইতিহাস জানানোর জন্যই তাদের হাতে ইংরেজিতে লেখা আমাদের সাহিত্য গ্রন্থ তুলে দিতে হবে। ১৮ নভেম্বর থেকে বিএলআরসি সেই দুরূহ কাজটির শুভ সূচনা করছে।
বিএলআরসির দুটি সম্মেলনেই দুটি সাহিত্য পত্রিকা উপহার দিয়েছে। ইংরেজি ও বাংলায় রচিত গল্প-প্রবন্ধগুলো দুই ভাষিক পাঠকদের জন্য একটি চমৎকার সংযোজন। বাংলা, বাঙালি, বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিন্যাস তা ইংরেজি ও বাংলায় ভবিষ্যতে স্থান পেলে কানাডীয় এবং বাঙালি পাঠকেরা উপকৃত হবেন। পরিশেষে বলা যায়, বিএলআরসি বাংলা সাহিত্য ও কানাডীয় সাহিত্যের মধ্যে সেতুবন্ধনের পথিকৃৎ হিসেবে দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে, তা যেন শত বাধার সামনেও ব্যাহত না হয়।