ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ (ব্রেক্সিট) কার্যকর করা নিয়ে আরও একটি টালমাটাল বছর কাটাল যুক্তরাজ্য। বছরজুড়েই দেশটির রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল বিচ্ছেদ প্রসঙ্গ। ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে গণতন্ত্রের আদি ভূমিখ্যাত যুক্তরাজ্যে সরকার ও পার্লামেন্ট মুখোমুখি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন থেরেসা মে। উত্থান ঘটেছে ব্রেক্সিটপন্থী হিসেবে পরিচিত ডানপন্থী রাজনীতিক বরিস জনসনের।
২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত এক গণভোটে যুক্তরাজ্যের মানুষ ইইউর সঙ্গে বিচ্ছেদের পক্ষে রায় দেন। এ রায় কার্যকর করা নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েন যুক্তরাজ্যবাসী। সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক অচলাবস্থার, যার রেশ চলতি বছরও বজায় ছিল। চলতি বছরের গত ২৯ মার্চ ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পার্লামেন্টের বিরোধিতার কারণে তা এখনো কার্যকর হয়নি। তিন দফা পিছিয়ে বিচ্ছেদের নতুন তারিখ আসছে নতুন বছরের ৩১ জানুয়ারি।
নানা বিতর্কের পর ইইউর সঙ্গে ব্রেক্সিট চুক্তি সম্পাদন করে অনেকটা স্বস্তি নিয়েই বছর শুরু করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। কিন্তু বছরের শুরুতেই তিনি হোঁচট খান। ১৫ জানুয়ারি ২৩০ ভোটের ব্যবধানে তাঁর সেই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে পার্লামেন্ট। দেশটির ইতিহাসে এত বড় ব্যবধানে পার্লামেন্টে সরকারের হারের নজির নেই। এ পরিস্থিতিতে মে বারবার ছুটে গেছেন ইইউর দরবারে। কিন্তু লাভ হয়নি। আরও দুই দফা পার্লামেন্ট তাঁর সেই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। থেরেসা মের গদি নড়বড়ে হয়ে যায়। কনজারভেটিভ দলের তৃণমূলের ৭০টি শাখা মের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের দাবি তোলে। পরে মে পদত্যাগের ঘোষণা দেন এবং নতুন নেতা হিসেবে ব্রেক্সিটপন্থী বরিস জনসনের আবির্ভাব হয়। ২৪ জুলাই বরিস জনসনের হাতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নেন থেরেসা মে।
বরিস জনসন ব্রেক্সিটপন্থীদের কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি ঘোষণা দেন, ‘বাঁচি আর মরি, ৩১ অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর করব।’ সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার দায়ে বরিস ২১ জন আইনপ্রণেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। এ ছাড়া ব্রেক্সিটবিরোধিতা এড়াতে তিনি ১০ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ সপ্তাহের জন্য পার্লামেন্ট স্থগিত রাখার কৌশল নেন। বিরোধীরা বিষয়টি আদালতে তোলে। ২৪ সেপ্টেম্বর দেশটির সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে সরকারের পার্লামেন্ট স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তকে অবৈধ বলে রায় দেন। ফলে আবারও শুরু হয় পার্লামেন্টের অধিবেশন।
এরপর বিচ্ছেদ কার্যকরে ১৭ অক্টোবর ইইউর সঙ্গে নতুন একটি চুক্তি সম্পাদন করেন বরিস। পার্লামেন্ট তাঁর সেই চুক্তিতে প্রাথমিক সমর্থন দিলেও ৩১ অক্টোবরের আগে চুক্তিটি পাসের বিরোধিতা করে। বাধ্য হয়ে বরিস ব্রেক্সিট পেছানোর ঘোষণা দেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি বিচ্ছেদের নতুন দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু বিচ্ছেদ পিছিয়ে যাওয়ায় আগাম নির্বাচনের প্রস্তাব আনেন বরিস।
এই বিচ্ছেদ পিছিয়ে যাওয়ায় বরিসের আগাম নির্বাচনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের আর কোনো অজুহাত ছিল না বিরোধীদের। ২৯ অক্টোবর বরিসের আগাম নির্বাচনের প্রস্তাবে সায় দেয় পার্লামেন্ট। সে অনুযায়ী ১২ ডিসেম্বর দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বিশাল বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছেন ব্রেক্সিটপন্থী বরিস জনসন। আর চরম হারা হেরেছে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লেবার দল। যে কারণে দলীয় নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন লেবার নেতা জেরেমি করবিন। বাম ধারার রাজনীতির নতুন আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হওয়া করবিনের এমন বিদায়ও ব্রিটিশ রাজনীতিতে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে থাকবে।
বরিস বিশাল সমর্থন নিয়ে নেতা হয়েছেন। ইইউ বিচ্ছেদ চুক্তি নিয়ে নতুন কোনো আলোচনা করবে না ঘোষণা দিলেও বরিস ঠিকই চুক্তিতে সংশোধনী আদায় করে নিয়েছেন। আগাম নির্বাচন দিয়ে বিশাল জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। এখন তাঁর সরকার ব্রেক্সিট ধাঁধার সমাধান কীভাবে করে, সেটিই দেখার পালা।