করোনাভাইরাস মহামারিতে বিশ্বজুড়ে এই প্রথমবারের মতো সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে পুরো পৃথিবীতে সব অঞ্চলে একযোগে এমন অভাবনীয় পরিস্থিতি দেখা যায়নি। প্রায় সব দেশেই শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ছেদ পড়েছে করোনার কারণে। এখন বিভিন্ন দেশ ধীরে ধীরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তবে করোনার তীব্রতাকে মাথায় রেখেই সাজাতে হচ্ছে পুরো কৌশল।
জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মহামারির শুরুতে বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৯০ শতাংশের শিক্ষা গ্রহণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা—সব অঞ্চলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল সরকারগুলোকে। যদিও অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশগুলো একপর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে বাড়ি থেকেই শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। তবে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সেই পড়াশোনায় শিক্ষার সামগ্রিক অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। আবার তথ্যপ্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা দেশের পক্ষে সেই সুবিধাটুকুও কাজে লাগানো সম্ভব নয়।
বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির আগেই পুরো পৃথিবীতে প্রায় আড়াই কোটি শিশু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। করোনাকালে বিভিন্ন দেশে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা তাই আরও বাড়বে। এ ছাড়া উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে কন্যাশিশুদের ওপর। বেড়ে যাবে বাল্যবিবাহ ও অপরিণত বয়সে মা হওয়ার হার। এর সামগ্রিক প্রভাব পড়বে একটি অঞ্চলের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক খাতে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনার কারণে প্রায় ৯০ লাখ শিশু শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে যেতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে মোট শিশুর ৫৩ শতাংশ দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছে মহামারির কারণে। এখনো বিশ্বজুড়ে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন শিশু বাড়ি থেকে শিক্ষা লাভ করছে। উন্নত-অনুন্নত ভেদে বিভিন্ন দেশে স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মূলত অনলাইনে নিজেদের কার্যক্রম চালু রেখেছে। উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে চালানো সমীক্ষায় দেখা গেছে, শিক্ষা কার্যক্রমের এই ব্যাঘাত শিক্ষার্থীদের দক্ষতায় বিশাল ঘাটতি সৃষ্টি করছে এবং সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য বাড়াচ্ছে।
তার পরও মূলত স্বাস্থ্যগত হুমকির কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্ততপক্ষে অবকাঠামোগতভাবে বন্ধ রাখার মতো সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোকে। ইউরোপ-আমেরিকায় অবশ্য গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষ হওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সময়টা ছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে। তখন ইউরোপ-আমেরিকায় করোনায় আক্রান্তের হার তুলনামূলকভাবে নিম্নমুখী ছিল। করোনায় মৃত্যুর হারও কিছুটা কমে এসেছিল। সব ধরনের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করেই ইউরোপ-আমেরিকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিশেষ করে মাস্ক পরিধান ও সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি কঠোরভাবে নিশ্চিত করা হয়েছিল।
কিন্তু শীতের শুরুতে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ ইউরোপ-আমেরিকায় আঘাত হেনেছে। আবার করোনায় শনাক্ত ও মৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে। ফলে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের বেশির ভাগ দেশকে ফিরে যেতে হয়েছে ভার্চ্যুয়াল ক্লাসে। স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়—পশ্চিমের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এ অবস্থা এখন। যুক্তরাষ্ট্রও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় খোলার বদলে বর্তমানে করোনার টিকাদান কার্যক্রম জোরদার করতে চাইছে। আমেরিকা-ইউরোপের সব দেশের সরকারগুলোর মূল ভরসা এখন করোনার টিকার ওপর। একটি নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
তবে স্কুল বা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়গুলো নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন জানিয়েছে, সব ধরনের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে বিভিন্ন রাজ্যের নানা অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ মূল ভূমিকা রাখবে। তবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষণপ্রক্রিয়া চালু রাখতে অর্থ ঋণ প্রদানসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এ-সংক্রান্ত বিবৃতি হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
যুক্তরাজ্য বলছে, বর্তমান লকডাউন শেষে বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় স্কুল খোলা হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, জানুয়ারির শুরু থেকে যুক্তরাজ্যজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। সম্প্রতি ব্রিটিশ সরকারের উপপ্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা জেনি হ্যারিস বলেছেন, লকডাউন শেষে বিভিন্ন অঞ্চলে করোনা সংক্রমণের হার ভিন্ন ভিন্ন হবে। সে ক্ষেত্রে কিছু কিছু অঞ্চলে সংক্রমণ নিম্নমুখী থাকলে স্কুল খোলা যেতে পারে। যদিও দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানক বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোদমে খুলে দেওয়া হয়তো খুব শিগগিরই সম্ভব হবে না।
জার্মানিতে গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইউরোপজুড়ে করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকায় তা আর খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি। আয়ারল্যান্ড ও স্পেনেও একই অবস্থা। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপের দেশগুলো এত দিন ভাবত সংক্রমণের ক্ষেত্রে শিশুদের ভূমিকা নগণ্য। তবে যুক্তরাজ্যে আবির্ভূত করোনার নতুন ধরন (স্ট্রেইন) সেই ভাবনাকে শঙ্কায় পরিণত করেছে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে এখন ধীরে চলো নীতিতে এগোচ্ছে ইউরোপ।
চীন ছিল করোনা সংক্রমণের শুরুর দিককার ভুক্তভোগী দেশ। শুরুতে বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পর গত বছরের মার্চের দিকে দেশটির কয়েকটি প্রদেশে স্কুল খোলা হয়। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরের দিকে প্রায় ২০০ মিলিয়ন শিক্ষার্থীকে স্কুলে ফিরিয়ে আনে চীন। দেশটির সরকার তখন দাবি করেছিল, এ থেকে প্রমাণ হয় যে করোনা মোকাবিলায় তাদের ব্যবস্থাই সবচেয়ে উন্নত।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত শিশুদের তাপমাত্রা মাপা, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা ইত্যাদি কঠোরভাবে মানা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে প্রযুক্তির সহায়তাও। তবে কোনো নিরপেক্ষ মাধ্যম থেকে এসব দাবি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ওদিকে ভারতে করোনা টিকা প্রয়োগের অনুমোদন দেওয়ার পর দেশটির সরকার স্কুল বা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, ভারতের কিছু অঞ্চলে দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির জন্য স্কুল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। খোদ রাজধানী নয়াদিল্লিতে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
হিন্দুস্তান টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান ও কর্ণাটকেও শিগগিরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। জি নিউজের খবরে বলা হয়েছে, পুনের কিছু অঞ্চলে জানুয়ারির শেষেই স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে অভিভাবকেরা আদৌ সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। এর আগে স্থানীয় কিছু জরিপে দেখা গেছে, করোনার সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকা অবস্থায় সিংহভাগ অভিভাবকই সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে ইচ্ছুক নন। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা সরকারের তরফে বলা হচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা ও মাস্ক পরায় কড়াকড়ি থাকবে। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকানোই এসব পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য।
জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকোর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, স্কুল বা যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের শিক্ষণপ্রক্রিয়ায় বড় ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের পুষ্টির অভাব, জাতীয় ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব, শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টিসহ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা আছে।
সব মিলিয়ে এটি বলা যায় যে করোনা মহামারির মধ্যে বিশ্বজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে বেশির ভাগ দেশ রক্ষণাত্মক কৌশলে এগোচ্ছে। এত দিন মূলত সংক্রমণ কমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে বিভিন্ন দেশে। আবার করোনা সংক্রমণের হার বাড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছে। তবে বর্তমানে করোনা টিকার প্রয়োগ শুরু হওয়ায় শিক্ষাক্ষেত্রে আশার আলো দেখা যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যদি করোনার টিকা প্রয়োগে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যায়, তবে হয়তো বিশ্বজুড়ে শিক্ষাব্যবস্থা আগের অবস্থায় দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়া যেতে পারে।