বিশ্বের আনাচকানাচে পৌঁছে গেছে ইন্টারনেট। অনলাইনে থাকার প্রবণতাও ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। এ প্রবণতায় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হচ্ছেন তরুণেরা। বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনের এই নতুন ঢেউয়ে অন্য সবকিছুর মতো বদল আসছে সংবাদমাধ্যমেও। এককথায়, সংবাদের ধরন পাল্টে দিচ্ছেন তরুণেরা।
অন্যান্য শিল্পের মতো সংবাদমাধ্যমেও লাভ-ক্ষতির হিসাব থাকে। সবাই চায় পাঠকের সংখ্যা বাড়াতে এবং পাঠকপ্রিয়তা পেতে। আর এই পাঠকসংখ্যার জনমিতিতেই ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে পুরো বিশ্বে। বর্তমানে পুরো পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বয়স ২০ বছরের কম। সুতরাং এই বিপুলসংখ্যক পাঠককে আকৃষ্ট করতে সংবাদ ও এর পরিবেশনার ধরন পাল্টে ফেলতে হচ্ছে। কাগজে ছাপা সংবাদে ক্রমেই আগ্রহ কমছে। অন্যদিকে অনলাইন হয়ে উঠেছে সংবাদ প্রকাশের মূল মঞ্চ। কারণ, প্রায় অর্ধেক বিশ্ব এখন ইন্টারনেটে যুক্ত। আবার এটুকুতেই শেষ নয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত সেই মঞ্চের সাজসজ্জাতেও আসছে বদল।
সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর গোষ্ঠী ওইসিডি বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ছাপা সংবাদপত্র পড়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে এই দেশগুলোর তরুণেরা। ধনী দেশগুলোর কিশোর-কিশোরীদের ৬০ শতাংশ আগে যেখানে ছাপা সংবাদপত্র পড়ত, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ২০ শতাংশে। সেই জায়গায় আসছে অনলাইন সংবাদমাধ্যম। বিশেষ করে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম তরুণদের কাছে সংবাদের উৎস হয়ে উঠছে। জনপ্রিয় হচ্ছে ইউটিউব ও নেটফ্লিক্সের মতো ভিডিও শেয়ারিং ও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট। ফলে বিপদে পড়ছে বিবিসি, সিএনএনের মতো প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো। যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রক সংস্থা অফকম বলছে, ইউটিউব বা নেটফ্লিক্সের মতো ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারলে ভবিষ্যতে তরুণ জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে হুমকির মুখে পড়বে বিবিসি।
আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টার জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের মোট কিশোর-কিশোরীর ৯৫ শতাংশ স্মার্টফোন ব্যবহারের সুযোগ পায় এবং এদের ৪৫ শতাংশ প্রায় সব সময় ‘অনলাইনে’ থাকে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের তরুণদের অভ্যাস বিশ্লেষণ করেছে রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব জার্নালিজম। বলা হচ্ছে, সংবাদের ক্ষেত্রে তরুণেরা পুরো সমাজের কথা ভাবে খুব কম। সংবাদের ক্ষেত্রে তরুণদের ব্যক্তিসত্তা বেশি কার্যকর থাকে। অর্থাৎ ব্যক্তি দৃষ্টিকোণ থেকে তরুণেরা সংবাদ মূল্যায়ন করে থাকেন, সামাজিক দৃষ্টিকোণ সেখানে গৌণ হয়ে যাচ্ছে।
একই অবস্থা আরব বিশ্বের দেশগুলোতে। সৌদি আরবে ১৮-২৪ বছর বয়সী তরুণদের ৮০ শতাংশ সংবাদ সংগ্রহ করেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থেকে। সেখানে সর্বগ্রাসী ভূমিকা রাখছে স্ন্যাপচ্যাট। অন্যদিকে এশিয়ার দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় ৯৭ শতাংশ কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী ‘নেইভর’ নামের একটি সার্চ ইঞ্জিন ও পোর্টালে সংবাদ খোঁজেন। ভারতে আবার তরুণেরা বিনোদন জগতের খবর জানতে বেশি আগ্রহী এবং ছাপা কাগজের চেয়ে অনলাইন বিভিন্ন মাধ্যমেই তাদের আগ্রহ বেশি। আবার আফ্রিকার দেশগুলোতে হোয়াটসঅ্যাপে পাওয়া তথ্যে প্রবল আস্থা রাখছেন তরুণেরা, সেসব ছড়াচ্ছেও বিদ্যুৎগতিতে।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, বিশ্বব্যাপী তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি থাকায়, তাদের নির্দিষ্ট অভ্যাসও শত শত কোটি ডলারের ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখছে। গণমাধ্যম ব্যবসার পালেও সেই হাওয়া লেগেছে। তরুণদের মধ্যে প্রায় সার্বক্ষণিক ইন্টারনেটে যুক্ত থাকার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায়, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোও সেভাবে নিজেদের বদলে ফেলতে চাইছে। ওদিকে তরুণেরাও বুঝতে পেরেছেন যে তাঁদের হাতে আছে জাদুকরী বদল আনার ক্ষমতা। এদিকে দৃষ্টি দিতে বাধ্য হচ্ছেন রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও গণমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিরা। প্রভাবশালীরা এখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প বা নরেন্দ্র মোদির অনলাইন সক্রিয়তাতেই তা স্পষ্ট।
একই চিত্র বাংলাদেশেও। প্রথম আলোর উদ্যোগে পেশাদার জরিপ সংস্থা ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেডের সাম্প্রতিক তারুণ্য জরিপে দেখা গেছে, মতামত প্রকাশ, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, দেশ-বিদেশের খবর, বিনোদন, কেনাকাটা—যাপিত জীবনের প্রায় সবকিছুর জন্য তরুণ-তরুণীরা নির্ভর করছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর। আর তাঁদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক। বাংলাদেশি তরুণদের পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে ইউটিউব। এ দেশের তরুণ-তরুণীরাও সংবাদ পেতে টেলিভিশনের পরই চোখ রাখছেন ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
মার্কিন ভোগ ম্যাগাজিনের অনলাইন প্রকাশনা ‘টিন ভোগ’-এর নির্বাহী সম্পাদক সংহিতা মুখোপাধ্যায় বলছেন, সংবাদের প্রতি তরুণদের প্রবণতা অত্যন্ত জটিল। তাঁরা একদিকে যেমন পপগায়ক জাস্টিন বিবারের দৈনন্দিন বিভিন্ন খবর জানতে চান, ঠিক তেমনি জানতে আগ্রহী গ্রেটা থুনবার্গের র্যালির খবর।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, তরুণেরা সবকিছুই চাক্ষুষ চাচ্ছেন। ফলে ভিডিও প্রতিবেদনের চাহিদা বাড়ছে। একটি বিশাল লেখা পড়ার চেয়ে ভিজ্যুয়াল কিছুতেই তরুণদের ক্লিক পড়ছে বেশি। ফলে ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম,হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটক ও স্ন্যাপচ্যাটের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রচলিত সংবাদমাধ্যমকেও এসব প্ল্যাটফর্মে উপস্থিতির জানান দিতে হচ্ছে জোরেশোরে। পশ্চিমা অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। এসব বিকল্প মাধ্যম অনেক ব্যক্তিকে বিখ্যাতও করে তুলছে, যেমন ইউটিউবার পিউডিপাই। এই ইউটিউব চ্যানেলটির সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১০ কোটি ২০ লাখ। অথচ আমেরিকার সব সংবাদপত্রের ছাপা ও ডিজিটাল মাধ্যম মিলিয়ে মোট সার্কুলেশন ৩ কোটির মতো।
নিন্দুকেরা বলছেন, তরুণেরা এসব বিকল্প মাধ্যম থেকে সংবাদ সংগ্রহ করছেন এবং সেগুলোতে ভেজালও থাকছে। কারণ, সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ও মূল ধারার গণমাধ্যমের মতো পেশাদারিত্ব রক্ষা ও সত্যাসত্য নির্ণয়ের ধার ধারছে না এসব বিকল্প মাধ্যম। প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব, যারা কোনো খবর জানানোর ক্ষেত্রে সত্য-মিথ্যার দায় নিতে অপারগ। সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা মানা তো দূর অস্ত। উসকানিমূলক বক্তব্যও দেওয়া হচ্ছে হরদম। ফলে সমাজে বিভক্তি ও ভুল তথ্যের জোয়ার দেখা দিয়েছে। কারণ, বারবার দেখলে মিথ্যাকেও যে সত্য বলে ভ্রম হয়। বিশ্বের তরুণদের একটি অংশও অবশ্য এর সঙ্গে একমত।
বাংলাদেশও এ থেকে ভিন্ন নয়। প্রথম আলোর উদ্যোগে করা তারুণ্য জরিপে অংশ নেওয়া ৭০ শতাংশের বেশি তরুণ-তরুণীর বক্তব্য হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারণা করে এবং ‘ফেক নিউজ’ ছড়ায়। অর্থাৎ ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাঁদের কাছে বেশি জনপ্রিয় হলেও এই মাধ্যম থেকে পাওয়া সংবাদে খুব একটা আস্থা পাচ্ছেন না তাঁরা।
তবে তাই বলে ফেসবুক-ইউটিউবের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ছে না। ভারতের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান টাইমস গ্রুপের ডিজিটাল উইংয়ের কর্ণধার সত্যেন গজওয়ানি বলছেন, যখন একজন পাঠক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থেকে কোনো খবর সংগ্রহ করছেন, তখন তিনি ওই নির্দিষ্ট সামাজিক মাধ্যমের প্রতিই অনুগত হচ্ছেন। হয়তো কোনো প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের তৈরি খবরই সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার হয়েছে, কিন্তু গণমাধ্যমের বদলে সংবাদের উৎস হিসেবে সামাজিক মাধ্যমকেই এগিয়ে রাখছেন পাঠকেরা। অনেক সময় পাঠকেরা সংবাদের মূল উৎস খোঁজার চেষ্টাও করেন না।
মূল ধারার সংবাদমাধ্যমকে তাই অস্তিত্বের লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে। বিশ্বের বড় বড় গণমাধ্যম গোষ্ঠী এখন সাম্প্রতিক বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে তাল মেলাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। এতে যেমন ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে, তেমনি বড় বড় ব্র্যান্ডের (পড়ুন ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি) আড়ালে বিলীন হয়ে যাওয়ার শঙ্কাও আছে। মাঝখানে সত্য-মিথ্যার গ্যাঁড়াকলে পড়েছে সমাজ নামের বিমূর্ত বস্তুটি। এত ঝড়ঝঞ্ঝা সামলে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যম কোন রূপে টিকে থাকে, সেটিই দেখার বিষয়।