উগান্ডার রাজধানী কাম্পালার মুলাগো হাসপাতালে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন জয়েস নামের বয়োবৃদ্ধ এক নারী। যন্ত্রণায় তাঁর মুখাবয়ব যেন দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। জয়েসের স্বামী তাঁকে বারবার শান্ত করার চেষ্টা করছেন। জয়েস ক্যানসারে আক্রান্ত। এর জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর সারা শরীরে। যন্ত্রণা থেকে নিবৃত্তি দিতে তাঁকে মরফিন দেওয়া হচ্ছিল। তবে কয়েক দিন আগে হাসপাতালে মরফিনের সংগ্রহ শেষ হয়ে যায়।উগান্ডার সরকার দেশটির হাসপাতালগুলোর জন্য মরফিন তৈরি ও সরবরাহ করে থাকে। তবে দুর্বল ব্যবস্থাপনার জন্য সরবরাহে বিপত্তির ঘটনা সেখানে হরহামেশাই ঘটছে।বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের মতে, নানা দিক বিবেচনায় তীব্র যন্ত্রণায় ভোগা রোগীদের জন্য মরফিন সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ। এটা দামে সস্তা; আবার সহজেই প্রয়োগ করা যায়। এর পরও প্রতিবছর তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে মৃত্যুবরণ করছে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, প্রতিবছর বিশ্বে ৫০ লাখের বেশি ক্যানসারে আক্রান্ত ব্যক্তি যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মারা যাচ্ছেন। মরফিন থেকে যাচ্ছে তাঁদের নাগালের বাইরে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে মরফিন ব্যবহারে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।মরফিনের ব্যবহার বাড়ানোর পক্ষে বিশ্বব্যাপী কাজ করা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান দ্য গ্লোবাল অ্যাকসেস টু পেইন রিলিফ ইনিশিয়েটিভের প্রধান মেগ ও ব্রেইন বলেন, ‘আসল বিষয় হচ্ছে, এসব মানুষ ও তাদের যন্ত্রণা নিবারণের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এমন একটি ওষুধ, যেটি নিতে সপ্তাহে খরচ পড়ে মাত্র দুই ডলার। আমার মতে, প্রকৃতপক্ষেই একটা অবিবেচনাপ্রসূত কাজ করা হচ্ছে।’ও ব্রেইন জানান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোতে ব্যথার রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত মরফিন রয়েছে। কিন্তু নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এ ধরনের রোগীর মাত্র ৮ শতাংশ এ সুবিধা পাচ্ছে। অনেক নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে মরফিন পাওয়ার বিষয়টি অসম্ভব বললেই চলে। অনেকের মতে, এ রকম দেশের সংখ্যা ১৫০। এর মধ্যে অনেক দেশের সরকার মরফিন সরবরাহ করে না বা সরবরাহ কমাতে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। তাদের উদ্বেগ, এটা নেশার দ্রব্য হেরোইন তৈরিতে ব্যবহার করা হবে। আবার অনেক চিকিৎসক রয়েছেন, যাঁরা ব্যথার রোগীর ব্যবস্থাপত্রে মরফিন লেখেন না এই ভয়ে যে সংশ্লিষ্ট রোগী এতে আসক্ত হয়ে যেতে পারে।ভারতের মতো দেশেও একই চিত্র। এখানকার দু-একটি হাসপাতালে রোগীদের জন্য মরফিন পাওয়া সহজলভ্য হলেও অধিকাংশ জায়গায়ই তা পাওয়া যায় না। মুম্বাইয়ের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিসজ্জিত টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের ব্যথানাশক বিভাগের প্রধান মেরি অ্যান মাকাডেন বলেন, তাঁদের হাসপাতালে কখোনোই এ ধরনের ওষুধের ঘাটতি পড়ে না। তবে দেশের অন্য সবখানে ভিন্ন চিত্র দেখা যাবে। তাঁর মতে, ভারতে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ মরফিন ব্যবহারের সুযোগ পায়।ভারতের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সিআইপিএলএর পরিচালক প্রিয়া কুলকার্নির মতে, মরফিনের ব্যবহার নিয়ে রোগীদের মধ্যেই শঙ্কা রয়েছে। অনেক সময় তারা এটাকে মৃত্যুর নামান্তর মনে করে থাকে। কারণ, কোনো চিকিৎসক যখন রোগীকে মরফিন নিতে বলেন, তখন সেই রোগী ধরে নেয়, চিকিৎসক তাকে বলে দিয়েছেন, ‘তোমার জন্য আমার আর কিছু করার নেই।’তবে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বর্তমানে এই চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন কুলকার্নিসহ অন্যরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিষয়টি এখন সঠিক পথেই এগোচ্ছে। কারণ, আন্তর্জাতিক মাদক নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের হিসাবে, ১৯৯৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত মরফিনের ব্যবহার বেড়েছে অন্তত ১০ গুণ। উগান্ডার মতো দেশগুলোতে যেখানে কয়েক বছর আগে মরফিন পাওয়াই যেত না, এখন কিছুটা হলেও সরবরাহ শুরু হয়েছে। বিবিসি।