বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হিমালয় পর্বতমালার মাউন্ট এভারেস্ট। এত দিন এর উচ্চতা জানা ছিল ৮ হাজার ৮৪৮ মিটার বা ২৯ হাজার ২৮ ফুট। কিন্তু নতুন করে এভারেস্টর উচ্চতা পরিমাপের পর জানা গেল, এই পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা আসলে ৮ হাজার ৮৪৮ দশমিক ৮৬ মিটার বা ২৯ হাজার ৩১ দশমিক ৬৯ ফুট। অর্থাৎ আগের হিসাবের চেয়ে এভারেস্ট প্রায় ১ মিটার বা ৩ ফুট উঁচু। চীন ও নেপালের কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার এক যৌথ ঘোষণায় নতুন উচ্চতার বিষয়টি জানিয়েছে।
তবে এভারেস্ট আগে থেকেই এতটা উঁচু, নাকি ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের পর এর উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট নেপাল ও চীনের সীমান্তবর্তী এলাকায় দাঁড়িয়ে। দুই দেশ থেকেই এই শৃঙ্গে উঠতে পারেন পর্বতারোহীরা। তবে এভারেস্টের উচ্চতা নিয়ে নেপাল ও চীনের মধ্যে বিতর্ক ছিল। ১৯৫৪ সালে ভারতের ব্যবস্থাপনায় এভারেস্টর উচ্চতা পরিমাপ করা হয়। ওই হিসাব অনুযায়ী, নেপাল এত দিন এভারেস্টের উচ্চতা উল্লেখ করত ৮ হাজার ৮৪৮ মিটার। তবে চীন এ হিসাব মানতে নারাজ। তারা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিমাপ করে জানিয়েছিল, এভারেস্টের উচ্চতা ৮ হাজার ৮৪৪ দশমিক ৪৩ মিটার বা ২৯ হাজার ১৭ ফুট। ২০০৫ সালে তারা এই উচ্চতা পরিমাপ করেছিল।
নেপাল ও চীনের হিসাবের তারতম্যের অবশ্য কারণও ছিল। নেপালের মতে, এভারেস্টের চূড়ায় জমাট বরফও এই পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতার অংশ। তবে চীন ওই বরফ বাদ দিয়ে হিসাব করেছিল। নেপাল সরকারের কর্মকর্তারা ২০১২ সালে বিবিসিকে বলেছিলেন, চীনা কর্তৃপক্ষ তাদের হিসাব করা এভারেস্টের উচ্চতা নেপালকে মেনে নিতে চাপ দিচ্ছে। পরে দুই দেশের কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে উচ্চতা পরিমাপে একমত হয়। এরই অংশ হিসেবে এ অভিযানে যোগ দিতে নেপালের চার পর্বতারোহীকে দুই বছরের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
নেপালের জরিপ বিভাগের মুখপাত্র দামোদার ঢাকল বিবিসিকে বলেন, ‘এর আগে আমরা নিজেদের ব্যবস্থাপনায় এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ করিনি। তবে এখন আমাদের তরুণ একটি দল রয়েছে।’
নেপালের জরিপকারী দলের নেতৃত্বে ছিলেন খিমলাল গৌতম। তিনি জানান, গত বছর এভারেস্টর উচ্চতা পরিমাপের জন্য পর্বতশৃঙ্গে উপকরণ সংযোজনের সময় তিনি তাঁর এক পায়ের বুড়ো আঙুল হারিয়েছেন। বরফে জমে আঙুলটি নষ্ট ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘পর্বতারোহীদের কাছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা পরিমাপ করতে পারাটা বিরাট এক অর্জন।’
এভারেস্টের উচ্চতা নিয়ে প্রশ্ন
কিছু ভূতত্ত্ববিদের ধারণা, ২০১৫ সালের শক্তিশালী ভূমিকম্পের প্রভাব পড়েছে মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতায়। রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে নেপালে প্রায় ৯ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ভূমিকম্পের প্রভাবে হিমালয়ে ধস নামে। এতে বরফে ঢাকা পড়ে কমপক্ষে ১৮ জন পর্বতারোহীর মৃত্যু হয়। এই ভূতত্ত্ববিদদের মধ্যে কয়েকজন মনে করেন, ওই ভূমিকম্পে এভারেস্টের উচ্চতা কমেছে। কারণ, এর শীর্ষের বরফের স্তূপ কমেছে।
বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন, হিমালয়ের লাংটাং হিমালসহ কিছু পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা ওই ভূমিকম্পের পর কমেছে। এসব পর্বতশৃঙ্গের বেশির ভাগেরই অবস্থান নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর উত্তরে, ওই ভূমিকম্পের উৎসস্থলের কাছে। এগুলোর উচ্চতা প্রায় এক মিটার পর্যন্ত কমে গেছে ভূমিকম্পের পর।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাকে শূন্য ধরে এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ করা হয়েছে। নেপালের জরিপকারী দল বঙ্গপোসাগরের পৃষ্ঠকে শূন্য ধরে পরিমাপ করেছে। অন্যদিকে চীনের জরিপকারীরা পীতসাগরের পৃষ্ঠকে শূন্য ধরে এগিয়েছেন।
তবে কয়েকজন ভূতত্ত্ববিদের দাবি, সময়ের পরিক্রমায় এভারেস্টসহ হিমালয়ের কয়েকটি পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা বেড়েছে। ভূগর্ভস্থ টেকটনিক প্লেটের স্থানান্তরের কারণে এমনটা হয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। ভূমিকম্পের একটি বড় কারণ ভূগর্ভের টেকটনিক প্লেটের স্থানান্তর।
নেপালের জরিপ বিভাগের মুখপাত্র দামোদার ঢাকল বলেন, ‘এভারেস্টের উচ্চতা আবার পরিমাপের উদ্যোগের অন্যতম কারণ হলো ২০১৫ সালের ভূমিকম্প।’
যেভাবে পরিমাপ করা হলো উচ্চতা
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাকে শূন্য ধরে এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ করা হয়েছে। নেপালের জরিপকারী দল বঙ্গপোসাগরের পৃষ্ঠকে শূন্য ধরে পরিমাপ করেছে। অন্যদিকে চীনের জরিপকারীরা পীতসাগরের পৃষ্ঠকে শূন্য ধরে এগিয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার পরিচালিত ইংরেজি ভাষার দৈনিক চায়না ডেইলি। দুই দলই উচ্চতা পরিমাপে ত্রিকোণমিতির সূত্র ব্যবহার করেছেন।
নেপালের জরিপকারী দল উচ্চতা পরিমাপের অংশ হিসেবে গত বছর এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করে। আর চীনের দল গত মে মাসে এভারেস্টে চড়ে। এর মাধ্যমে চীনা দলটি ২০২০ সালে এভারেস্টের চূড়ায় ওঠা প্রথম দল। করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে নেপাল ও চীন চলতি বছর হিমালয়ে পর্বতারোহণ বন্ধ রেখেছে।
চায়নিজ অ্যাকাডেমি অব সার্ভেয়িং অ্যান্ড ম্যাপিংয়ের সহকারী গবেষক জিয়াং টাও চায়না ডেইলিকে বলেন, ‘জরিপকারীর এভারেস্টের চূড়ায় আলো জ্বালানোর পর নিচের ছয়টি পয়েন্ট থেকে ত্রিকোণমিতির সূত্র ব্যবহার করে উচ্চতা পরিমাপ করা হয়েছে। অর্থাৎ উচ্চতা নির্ণয়ে ছয়টি ত্রিভুজের হিসাব বের করতে হয়েছে।’
উভয় দেশের দলই গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম ব্যবহার করেছে। চীনের দলটি ব্যবহার করেছে নিজেদের কৃত্রিম উপগ্রহের তথ্য। অর্থাৎ তারা চীনের বেইদু নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম ব্যবহার করেছে। এই ব্যবস্থাকে যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএসের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হয়। নেপালের দলটি জিপিএস ব্যবহার করেছে।