যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১৪ সালে রাশিয়াকে ‘আঞ্চলিক শক্তি’ বলে উপহাস করেছিলেন। ওবামার চোখে রাশিয়া তখন প্রতিবেশীদের উত্ত্যক্ত করার মতো ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ, বিশ্বদরবারে প্রভাব রাখার যোগ্যতা তার নেই।
পাঁচ বছর পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এখন ওবামার সেদিনের কথাগুলো স্মরণ করে কৌতুকবোধ করতে পারেন। কারণ, বিশ্ব ক্রীড়ামঞ্চে রাশিয়া এখন অন্যতম খেলোয়াড়।
গেল পাঁচ বছরে পুতিন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাশিয়ার অবস্থান শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্য সংকটে মোড়লিপনা করেছেন, চীনের সঙ্গে গড়েছেন কৌশলী সম্পর্ক। পাশাপাশি তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ন্যাটোর মিত্রদের মধ্যে একটি শক্ত গজ গেড়ে দিয়েছেন।
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, সিরিয়ার ভাগ্য নির্ধারণে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আলোচনার জন্য আরামদায়ক জায়গা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফ্লোরিডার বাসভবনের চেয়ে রাশিয়ার সোচিতে পুতিনের বাসভবন উপযুক্ত স্থান বলে মনে করেছেন। এ উদ্দেশ্যে এরদোয়ান ২২ অক্টোবর রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। সেখানে এরদোয়ান পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করে যৌথ সামরিক চুক্তি করেন। এই চুক্তির জন্য মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে। এরদোয়ানের যাওয়ার এক দিন পর ২৩ অক্টোবর অস্ত্র ও অর্থের সন্ধানে আফ্রিকার ৪০ নেতা রাশিয়ায় যান।
রুশ সেনারা মার্কিন বাহিনীর এক দিন আগেই সিরিয়াতে তাদের অবস্থান পোক্ত করেছে। ব্লুমবার্গ বলছে, এই এক ঘটনাই জানান দিচ্ছে, সিরিয়া সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে গেছে রাশিয়া।
এ বছরের অক্টোবরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র সৌদি আবর পুতিনকে স্বাগত জানিয়েছে। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান পুতিনের সম্মানে সৌদি সামরিক বাহিনী দিয়ে রাশিয়ার জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন।
চীনের সঙ্গে কৌশলগত মিত্রের সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন পুতিন। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং মনে করেন, তাঁর বড় বড় প্রকল্পে রাশিয়া সাহায্য করতে পারবে। পারমাণবিক অস্ত্রের আক্রমণ ঠেকাতে চীন নতুন সতর্কতা ব্যবস্থা নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছে। পুতিন ওই প্রকল্পে সহায়তা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ইউরোপে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষিত মিত্ররাও রাশিয়ার দিকে নরম দৃষ্টিতে চাইছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁখো বলেছেন, ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাশিয়ার প্রয়োজন।
প্রশ্ন হলো, রাশিয়া কীভাবে এত দ্রুত বিশ্বব্যাপী নিজের এমন ভাবমূর্তি গড়ল। মূলত, ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি ও পুতিনের সঠিক মুহূর্তকে বেছে নেওয়ার ক্ষমতাই রাশিয়াকে এমন সুযোগ দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক সাময়িকী ফরেন অ্যাফেয়ার্স বলছে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির প্রায় প্রতিটি দিকে হস্তক্ষেপ করেছেন। এই হস্তক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনেনি। জাতীয় স্বার্থের দোহাই পেড়ে ট্রাম্প মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও সরকারি প্রক্রিয়ার বাইরে নিয়েছেন। এ ধারা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আরও বেড়েছে। ট্রাম্পের এই নীতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ভুগছে, দেশটি মিত্রদের হারাচ্ছে এবং মার্কিন প্রতিপক্ষ বিশেষত রাশিয়া সুবিধা পাচ্ছে।
মাত্র তিন বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ছিল। বিশ্বের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দেশটি প্রভাব বিস্তার করতে পারত। তবে ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প সবকিছু থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছেন। প্রেসিডেন্টের দপ্তরে বসেই ট্রাম্প একের পর এক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সমঝোতা বাতিল করেছেন। ১২টি দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি ‘ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ’ থেকে বের হয়ে গেলেন। ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করলেন। নিজের দেশকে প্রত্যাহার করে নিলেন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে। রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক মিসাইল–সংক্রান্ত চুক্তি ‘ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জনিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) ট্রিটি’ থেকেও বেরিয়ে গেছেন ট্রাম্প। এ ছাড়া একের পর এক বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা এবং মিত্রদেরকে নানান হুমকি দিচ্ছেন।
ফরেন অ্যাফেয়ার্স বলছে, পররাষ্ট্র অথবা অভ্যন্তরীণ—যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে ট্রাম্প প্রথা মানেন না। তিনি বিশেষজ্ঞ মতামতের ধারেকাছেও ভেড়েন না। জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সিদ্ধান্ত নিতে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের (এনএসসি) সভায় যান না। পরিবর্তে নিজের জ্ঞানের ওপর ভর করে সিদ্ধান্ত নিতে স্বস্তি পান। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক বিভিন্ন কর্মপন্থা নির্ধারণের প্রক্রিয়াকে এরই মধ্যে দুর্বল করে ফেলেছেন ট্রাম্প। যেসব দক্ষ লোক নিরাপত্তাবিষয়ক বিভিন্ন কর্মপন্থা নির্ধারণ ও পরিচালনা করতেন, তাঁদের তিনি দূরে সরিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিশ্বাসযোগ্যতা ও দক্ষতায় ক্ষত তৈরি করেছেন ট্রাম্প। বিশ্বব্যাপী মার্কিন কূটনীতির মতো শক্ত কাজ তিনি যেন একাই সেরে ফেলতে চান। পররাষ্ট্র দপ্তর চালানোর এই রীতিতে আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, চীন ও উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা সফল হয়েছেন। তবে আঘাতটা লেগেছে ভেতরে। এই রীতির কারণে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ট্রাম্পের এমন ধারায় দেশ চালানোয় মার্কিন জাতীয় স্বার্থে বিপর্যয় নেমে এসেছে, আর এটা আশীর্বাদ হয়েছে পুতিনের জন্য।
ব্লুমবার্গ বলছে, কূটনৈতিক বিষয়ে পুতিন নমনীয় মনোভাব দেখান। তিনি বিশ্বাস করেন, পৃথিবীর কোনো দেশেরই চিরস্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলে কিছু নেই। যেটা আছে তা হলো চিরস্থায়ী স্বার্থ। এ কারণে ২০১৫ সালে যে তুরস্ক রাশিয়ার যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিল, কিছুদিন না যেতেই তাকে আপন করে নিলেন পুতিন। সম্প্রতি তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে অত্যাধুনিক এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিনেছে। এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ন্যাটোর কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ এঁকে দিয়েছে। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র আরবের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে পদক্ষেপ নিয়েছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেছেন, মিসরের দিকেও এগোচ্ছেন। এসবের পাশাপাশি পুতিন নজর দিয়েছেন মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোর দিকে।
পূর্বতন কলোনি মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র থেকে ফ্রান্স ২০১৭ সালে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। এতে দেশটিতে ক্ষমতার ভারসাম্যে শূন্যতা তৈরি হয়। পুতিন এই সুযোগ লুফে নেন। ফ্রান্সের চলে যাওয়ার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই পুতিনের পক্ষ থেকে রাশিয়ার ব্যবসায়ীরা মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে হাজির হন। এর কিছুদিন পরে রাশিয়ার সেনারা সেখানে নামেন।
পুতিনের এমন ধারায় এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, সামনের দিকে যেতে তিনি কিছু নীতি মেনে চলেন। তিনি মিত্রদের সমর্থন করেন, রাশিয়ার সবল দিকগুলো নানাভাবে কাজে লাগান, সংকটের সময় একেবারে ধীরস্থির থাকেন এবং প্রতিপক্ষকে সুযোগ করে দিতে পারে—এমন জায়গা কখনো ছাড়েন না।
অবশ্য বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে রাশিয়া এখনো অনেক পিছিয়ে। দ্য ইকোনমিকস বলছে, অর্থনৈতিক চুক্তির জায়গাতে রাশিয়ার বাগাড়ম্বর ও বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে বিস্তার ফারাক। ২০১৮ সালে রাশিয়া সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলোতে ৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করেছে। একই সময়ে ওই এলাকাতে আমেরিকার বাণিজ্য ছিল ১২০ বিলিয়ন ডলার। সামরিক ক্ষেত্রেও এই অঞ্চলে রাশিয়া কিছুটা অনুজ্জ্বল। পুতিনের দাবি, আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে তিনি অন্তত ৩০টি যৌথ সামরিক চুক্তি করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত ওই সব দেশে কিছু গৌণ সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়া বড় কোনো মহড়া দেখাতে পারেননি পুতিন।
নিজ ঘরেও পুতিন নানা সমস্যার উল্লেখযোগ্য সমাধান করতে পারেননি। রাশিয়ার জমা করে রাখার মতো অর্থের পরিমাণ টানা ছয় বছর ধরে নিম্নমুখী। ক্রমাগত দুর্নীতির ঘুরপাকে পড়ে রাশিয়ার জনগণ ক্ষুব্ধ। তাই সোভিয়েত ধাঁচে বিশ্বব্যাপী রাশিয়ার প্রভাব তৈরি করতে চাইলে পুতিনকে ঘরে ও বাইরে—দুটোই সামাল দিয়ে হাঁটতে হবে আরও বহু পথ।