শাস্ত্রীয় সংগীতের বিরল প্রতিভা কণ্ঠশিল্পী কৌশিকী চক্রবর্তী প্রিয় শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম একজন। তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল একবার।
কানাডার বেদান্ত সোসাইটি অব টরন্টোর সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে ১৫ সেপ্টেম্বর অন্টারিও প্রদেশের মিসিসগা শহরের লিভিং আর্টস সেন্টারের হেমারসন হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানেই কৌশিকী চক্রবর্তী আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন গান গাইতে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ছিল বিশিষ্টজনদের বক্তব্য ও স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনা। দ্বিতীয় পর্বে কৌশিকী চক্রবর্তী দুই ঘণ্টা তাঁর ঐন্দ্রজালিক সুরের মূর্ছনায় জড়িয়ে রাখলেন সংগীতপ্রেমীদের।
এই শিল্পীর শেকড় বাংলাদেশে তথা ময়মনসিংহে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় তাঁর ঠাকুর দাদা সংগীত শিক্ষক অজিত কুমার চক্রবর্তী পরিবারসহ ময়মনসিংহ থেকে কলকাতায় চলে যান। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কৌশিকী ১৯৮০ সালের ২৪শে অক্টোবর কলকাতায় বাবা পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী ও স্বনামধন্য সংগীতজ্ঞ মা চন্দনা চক্রবর্তীর ঘরে জন্ম নেন। মাত্র দুই বছর বয়সে মায়ের কাছে গান শিখতে শুরু করেন। বাবার কাছে গান শেখার হাতেখড়ি হয় সাত বছর বয়সে। দশ বছর বয়সে তিনি পদ্মভূষণ পণ্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ মহাশয়ের কাছে তালিম নেওয়া শুরু করেন। গুরু জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ কৌশিকীর বাবা অজয় চক্রবর্তীরও গুরু ছিলেন। পরে তিনি আইটিসি একাডেমি থেকে সাফল্যের সঙ্গে সংগীতের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন।
২০১৫ সালে তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীতকে ভিত্তি করে গীত, বাদ্য, ও নৃত্যের সমন্বয়ে সখীœনামে একটি ব্যান্ড গড়ে তুলেছেন, যার ছয়জন শিল্পীই হলেন নারী।
কৌশিকী চক্রবর্তী সান্ধ্যকালীন রাগ ইমন দিয়ে তাঁর পরিবেশনা শুরু করেন। এই মৌলিক রাগের ওপর দুটি খেয়াল পরিবেশন করেন যার প্রথমটি ছিল ত্রিতালে বাঁধা আর অন্যটি ঝাঁপতালে। উদারা, মুদারা আর তারা-তিনটি অকটিভেই স্বতঃস্ফূর্ত যাওয়া আসার কি অদ্ভুত গায়নশৈলী!
এরপর তিনি তাঁর বাবা পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর সেমিক্লাসিক্যাল কম্পোজিশন‚ শ্যাম বাঁশুরিয়া বাজিয়েœশোনান। উত্তর ভারতীয় হিন্দুস্থানি রাগ সংগীতের পাশাপাশি দক্ষিণ ভারতীয় কর্ণাটী সংগীতেও তালিম নেওয়া এই শিল্পী এরপর হংসধ্বনি রাগের ওপর গাইলেন একটি কর্ণাটী খেয়াল। পরের পরিবেশনে হংসধ্বনি রাগের ওপর জনপ্রিয় খেয়াল‚ লাগি লগণœশুনিয়ে শিল্পী ভরিয়ে তুললেন প্রায় দেড় হাজার সংগীত পিপাসুর মন আর করতালিতে ভরে উঠলো পুরো হল ঘর। পরে দর্শক–শ্রোতার অনুরোধে ভৈরবী রাগের ওপর দুটো ভজন গাইলেন। প্রথমটি সাধক কবিরের সুপরিচিত ভজন প্রভু, ম্যা গোলাম ম্যা গোলাম ম্যা গোলাম তেরা, তু দেওয়ান তু দেওয়ান তু দেওয়ান মেরাœএবং শেষ গানটি ছিল ইউটিউবে ৩০ লাখের বেশি বার শ্রোতাদের শোনা শিল্পীকণ্ঠের সেই জনপ্রিয় ভজন তুম অজানা ভগবান।
অনুষ্ঠান শেষে কৌশিকীর বিক্রিত ফ্ল্যাশ ড্রাইভের কভারে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য অন্যান্য আগ্রহী দর্শক-শ্রোতাদেরা সঙ্গে লবিতে অপেক্ষা করছিলাম। খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সুহাসিনী কৌশিকী হেঁটে এলেন লবিতে। পরনে তাঁর সোনালি ও সবুজ পাড়ের হলদে-সোনালি রঙের শাড়ি আর একগোছা ঘন কালো চুল ডানপাশে ছড়ানো। তাঁর সুরের মতোই মোহনীয় তাঁর মুখমণ্ডল। এতো আন্তরিকভাবে কথা বললেন মনে হল তিনি যেন খুব কাছের মানুষ। গানের মঞ্চে তাঁকে দেখে মনে হয় যেন জ্যোতির্ময়ী এক সম্রাজ্ঞী যে সূর্যের মতো দীপ্ত আর প্রখরতার উজ্জ্বল আলো ছড়ায় তাঁর কর্তৃত্বপূর্ণ সুরের চলনে। কিন্তু কাছ থেকে তাঁকে দেখে মনে হলো ঠিক তাঁর বিপরীত যেন রাতের আকাশে নরম আলোর এক মায়াবী চাঁদ-মমতাময়ী একজন সখি, ভালোবেসে যার হাতে বেলি ফুলের রাখি বাঁধা যায়। বেলি ফুলের গন্ধ নিতে নিতে মৃদুভাষী কৌশিকী বললেন, ‘বাহ, কী সুন্দর! তোমার বাগানের? আমার প্রিয় ফুল বেলি।’
অটোগ্রাফ দিতে গিয়ে চমৎকার ইংরেজি টানা হাতের লেখায় লিখলেন, ‘মানসীদি’।
সংগীতময় আনন্দসন্ধ্যায় শিল্পী কৌশিকী চক্রবর্তীর বাহ্যিক সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে প্রকাশিত হল তাঁর বিকশিত অন্তরের লাবণ্যময় শোভা। এই মহীয়ান নারী শুধু বিশুদ্ধ সংগীতের সুর সম্রাজ্ঞীই নন তিনি একজন অমায়িক মানুষও বটে। প্রকৃত শিল্পীর তিনি এক শাশ্বত উপমা। তাঁর আত্মায়-চিন্তায়-মননে যে সুরের প্রদীপ প্রজ্বলিত তা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হোক আর আলোকিত করুক সংগীত পিপাসুদের অন্তরাত্মা।